সূচনা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ভারতের এক ভয়াবহ অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হয়। কংগ্রেসের ভারত ছাড়ো প্রস্তাব গ্রহণ, নৌ বিদ্রোহ এবং আজাধীন সেনাদের বিচারকে কেন্দ্র করে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে একের পর এক নানা আন্দোলন ও ধর্মঘট সংগঠিত হতে থাকে। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে নৌ বিদ্রোহ, মুসলিম লীগের উদ্যোগে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বৃদ্ধি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেনের অর্থনৈতিক দুর্বলতা, ভারতকে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে ব্রিটেনকে আমেরিকার চাপ ব্রিটেনে স্পষ্টতই উপলব্ধি করে যে ভারত সহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ উপনিবেশিক সাম্রাজ্যের পতন সুনিশ্চিত। ডায়াবে ব্রিটিশ ভারতের ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রচেষ্টা হিসেবে বৃটিশের তরফ থেকে একাধিক পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নেয়া হয়।
ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রেক্ষাপট ও ব্রিটিশের ভূমিকা
১. ব্রিটিশের উদ্যোগ
যুদ্ধকালীন সময়ে ভারতের রাজনীতিতে এক অচলাবস্থা তৈরি হয়। কংগ্রেস এবং লীগের মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধি পায়। জিন্না পাকিস্তান দাবিতে অটল থাকা এই দূরত্ব বৃদ্ধি পায়। অপরদিকে বড়লাট লিনলিথনগোর স্থলে নতুন বড়লাট ওয়াভেল ভারত নিয়ে উদ্ভূত সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ নেন। তিনি লন্ডনের ব্রিটিশ মন্ত্রীসভা কে ভারতে নেতাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনার অনুরোধ জানান।
২. ওয়াভেল পরিকল্পনা
(১) প্রেক্ষাপট : ভারতের রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িক সংকট মীমাংসা গান্ধী জিন্না আলোচনা ব্যর্থ হয়। এর ফলে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয় তা দূর করার জন্য ওয়াভেল ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই জুন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের কাছে একটি সূত্র উত্থাপন করেন, সেইটাই ওয়াভেল পরিকল্পনা নামে খ্যাত। সে সময় ভারত সচিব এল. এস. এমেরি এই পরিকল্পনা সম্পর্কে বলেন -“আমরা ভারতীয়দের হাতেই তৎক্ষণিক ভবিষ্যৎ তুলে দিতে চাই।”
(২) সুপারিশ : ওয়াভেল ভারতীয়দের হাতে অধিক দল ক্ষমতা ও দায়িত্ব অর্পণ করে কেন্দ্রীয় শাসন পরিষদ পূর্ণ গঠনের সুপারিশ ও করেন। তিনি বলেন – (i) নতুন সংবিধান গৃহীত না হওয়া পর্যন্ত ভারতীয় নেতাদের নিয়ে অন্তবর্তী সরকার গঠন করা হবে। (ii) বড়লাটের শাসন পরিষদে বর্ণ হিন্দু ও মুসলমান সদস্য সংখ্যা সমান থাকবে। (iii) একমাত্র বড়লাট ও প্রধান সেনাপতি ছাড়া শাসন পরিষদে অন্য সমস্ত সদস্য হবে ভারতীয়। (iv) ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে পর্যন্ত ভারতের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব ব্রিটিশের হাতেই থাকবে। (v) সরকার যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি ক্ষমতা হস্তান্তর করবে এবং সংবিধান রচনার কাজ আরম্ভ করবে।
৩. সিমলা বৈঠক
(১) আয়োজন : ওয়াভেলের পরিকল্পনা মেনে সিমলায় এক বৈঠক বসে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ২৫ জুন। কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও অন্যান্য দলে নেতাদের এই সম্মেলনে যোগ দেয়ার আহ্বান জানানো হয়। কংগ্রেস জাতি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই সম্মেলনে যোগ দেয় তার জন্য ইতিপূর্বে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সমস্ত বন্দি সদস্যদের মুক্তি দেয়া হয়। এই বৈঠক চলে ২৫ জন থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত। কংগ্রেসের পক্ষে মৌলানা আজাদ এবং মুসলিম লীগের পক্ষে জিন্না এই বৈঠকে প্রতিনিধিত্ব করেন।
(২) আলোচনার বিষয় : সিমলা বৈঠকে বড়লোক ওয়াভেলের পরিকল্পনাগুলি আলোচিত হয়। তবে এই বৈঠকের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল দুটি- প্রথমটি ছিল, বড়লাটের কাউন্সিল বা শাসনপরিষদ যে সমস্ত নীতির ভিত্তিতে কাজ করবে সেগুলি ঠিক করা। দ্বিতীয়টি ছিল, কাউন্সিল কিভাবে গঠিত হবে বা এই কাউন্সিলের কালার সদস্য হবে তা ঠিক করা। তবে সিমলা বৈঠকের আলোচনা ক্ষেত্রে ব্রিটিশ চেয়েছিল ভারতের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে কংগ্রেস, লিক এবং শিখ নেতাদের কিভাবে সরকার পরিচালনায় সাহায্য করতে পারে তার সূত্র বের করতে।
(৩) পরিণতি : স্বায়ত্ত শাসন অর্জনের লীগের সঙ্গে ঐক্য মত্ত গড়ে তোলার জন্য কংগ্রেস মুসলিমদের সম প্রতিনিধিত্বের দাবি মেনে নিয়েছিল। কিন্তু জিন্না যখন বড়লাটের কার্যনির্বাহক সমিতিতে লীগের ধারা মুসলিম সদস্য নিয়োগের দাবি জানান তখন কংগ্রেস সে দাবি মেনে নিতে চাইনি। লীগের অমনিনীয় মনোভাবের ফলে শেষ পর্যন্ত সিমলা বৈঠক ব্যর্থ হয়। এছাড়া বৃটেনের রক্ষণশীল দল ও ভারত ত্যাগ করতে রাজি ছিল না। ফলে সিমলা বৈঠক ব্যর্থ হয়।
৪. ক্যাবিনেট মিশন বা মন্ত্রী মিশন
(১) পরিচয় : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বের বৃটেনের শ্রমিক দল ক্ষমতা লাভ করলে নতুন ব্রিটিশ মন্ত্রিসভা ভারতীয় নেতৃবর্গের সঙ্গে আলাপ আলোচনার জন্য তার তিনজন সদস্যকে ভারতে পাঠাবার সিদ্ধান্ত নেয় ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ১৯ শে ফেব্রুয়ারি। ভারত সচিব পেথিক লরেন্স, বাণিজ্য সচিব স্ট্যার্ফোড ক্রিপস এবং নৌ-সচিব এ. ভি. আলেকজান্ডার এই তিনজন মন্ত্রী কে নিয়ে গড়া উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন এই দলটি ভারতের ইতিহাস ক্যাবিনেট মিশন বা মন্ত্রী মিশন ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ নামে বিখ্যাত।
(২) উদ্দেশ্য : মন্ত্রী মিশন এর উদ্দেশ্য ছিল দুটি- (i) ভারতকে স্বাধীনতা দান এবং ভবিষ্যৎ সংবিধান রচনার জন্য যে গণপরিষদ তৈরি হবে তার গঠন, পদ্ধতি ও নীতি নির্ধারণ করা। (ii) ভারতের সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলি বিদ্যুততার মৈতকের ভিত্তিতে অন্তবর্তী কালের জন্য একটি জনপ্রতিনিধি ভিত্তিক সরকার গঠন করা।
(৩) প্রস্তাব : এই মিশনের প্রধান প্রস্তাবগুলি ছিল- (i) ভারতের একটি দ্বিস্তর বিশিষ্ট যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হবে। দেশীয় রাজ্যগুলির এই যুক্তরাষ্ট্রে যোগ দিতে পারবে। (ii) কেন্দ্র ও প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে। দেওয়াল মাত্র পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও যোগাযোগ বিষয়ক ক্ষমতা থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর। প্রদেশ গুলিতে পূর্ণ স্বায়ত্ত শাসন প্রবর্তিত হবে। (Iii) প্রাদেশিক উন্নতি তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হবে-মাদ্রাজ, বোম্বাই, উত্তর প্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ ও উড়িষ্যা নিয়ে গঠিত হিন্দু প্রধান বা ক বিভাগ, মুসলিম প্রধান বা খ বিভাগ এবং বাংলা ও আসাম নিয়ে একটি পৃথক বিভাগ বা গ বিভাগ। এই বিভাগগুলি নিজে নিজে আঞ্চলিক সংবিধান প্রণয়নের অধিকার থাকবে।
(iv) ভারতের যুক্তরাষ্ট্রের যোগদানের ইচ্ছুক দেশীয় রাজ্য ও প্রদেশ গুলির নির্বাচিত সদস্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধান রচনার জন্য গণপরিষদ গঠিত হবে। (v) নতুন সংবিধান চালু হলে যে কোন নির্বাচিত প্রাদেশিক আইনসভার ইচ্ছা করলে যে কোন বিভাগে যোগ দিতে কিংবা যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতেও পারবে। (iv) যতদিন না নতুন সংবিধান প্রণীত হয়, ততদিন ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার গঠন করা হবে।
(৪) গুরুত্ব : ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাবগুলি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই কারণগুলি হল –
(i) অবিভক্ত রাখার শেষ প্রয়াস হিসাবে : মিশনের সদস্যরা স্পষ্টই বুঝে গিয়েছিল যে, ভারত ভেঙে পাকিস্তান সৃষ্টি এই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানের সঠিক কোন পথ নেই।
(ii) প্রতিনিধি নির্বাচনী অধিকারদানে : এই প্রথম দেশীয় রাজ্যের জনগণকে প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার দেওয়া হয়।
(iii) অসাম্প্রদায়িক শাসনতান্ত্রিক পদক্ষেপ হিসেবে : এতদিন শাসনতান্ত্রিক আলোচনার ক্ষেত্রে ভারতের বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকে কেন্দ্র করে নানা জটিলতা সৃষ্টি হতো। মন্ত্রী মিশন তাদেরকে মুক্তি পেতে হিন্দু, মুসলিম ও পাঞ্জাবির ক্ষেত্রে শিখ ছাড়া অন্য কোন সম্প্রদায়কে সেক্ষেত্রে স্বীকৃতি না দিয়ে এক ইতিহাস সৃষ্টি করে।
(iv) ভারতীয় সদস্য গ্রহণের ক্ষেত্রে : গণপরিষদ কোন অভারতীয় সদস্য গ্রহণের প্রস্তাব ছিল না।
(v) গণপরিষদের ক্ষমতা : ভারতীয় শাসনতন্ত্র রচনার ক্ষেত্রে গণপরিষদকেই সর্বভৌম ক্ষমতা দেয়া হয়।
৫. মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা
(১) পটভূমি :
(i) মাউন্টব্যাটনের আগমন : ভারতের ক্ষমতা হস্তান্তরের কাজ দ্রুত সম্পাদনের জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টের লর্ড ওয়াভেলের জায়গায় মাউন্টব্যাটনের ভাইসয়র নিও করে ভারতে পাঠায় বাইশে মার্চ ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ।
(ii) মাউন্টব্যাটনের লক্ষ্য : মাউন্টব্যাটনের লক্ষ্য ছিল অখন্ড ভারত। নেত্র মন্ডলী ও রাজন্যবর্গের সঙ্গে ১৩৩টি বৈঠক করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই নতুন বড়লাট বুঝে নেয় যে ভারত বিভাগ ছাড়া ভারতীয় সমস্যার কোন সমাধান নেই। তিনি উপলব্ধি করেন ভারত বিভাগ বিষয়ে দেরি করার অর্থ হলো পাঞ্জাব, বাংলা ও অন্যান্য স্থানে চলমান দাঙ্গাকে দীর্ঘস্থায়ী করা এবং আরো বেশি মানুষের জীবনে ও সম্পত্তির বিনাশে সাহায্য করা। তিনি জানান সম্ভবত ১৫ ই আগস্ট ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পূর্ণ করা হবে।
(২) বিভিন্ন প্রস্তাব : মাউন্টব্যাটেন প্রস্তাবে বলা হয়-
(i) ভারতবর্ষকে বিভক্ত করে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি ডোমিনিয়নের সৃষ্টি করা হবে। ডওমইনইয়ন দুটি সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নিজে নিজে অভ্যন্তরীরও বৈদেশিক বিষয় সমূহ পরিচালনা করব।
(ii) মুসলমান প্রধান প্রদেশ -সিন্ধু, ব্রিটিশ অধিকৃত বালুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পশ্চিম পাঞ্জাব ও পূর্ব বাংলা নিয়ে পাকিস্তান গড়া হবে।
(iii) পাঞ্জাব বাংলাকে বিভক্ত করে কোন অঞ্চলকে কোন ডোমিনিয়ন এর সঙ্গে যুক্ত করা হবে তা নির্ধারণের জন্য একটি সীমান্ত নির্ধারণ কমিশন ক্ষমতা হস্তান্তরের আগেই গঠিত হয়।
(iv) আসামের শ্রীহট জেলা কোন ডোমিনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হবে তা গণভোটে স্থির হয়।
(v) দেশীয় রাজ্যগুলি নিজেও নিজেও রাজ্যের সর্বভৌম ক্ষমতা লাভ করবে এবং ইচ্ছা করলে তারা যে কোনো ডোমিনিয়ন এর যোগ দিতে পারবে।
(vi) প্রতি ডোমিনিয়ন নির্বাচিত গণপরিষদ বিজয় এলাকায় সংবিধান রচনা করবে।
(vii) যতদিন না সংবিধান রচিত হচ্ছে ততদিন ব্রিটিশ সরকার নিযুক্ত একজন গর্ভনার জেনারেল ওই ডোমিনিয়ন থাকবেন।
(viii) স্বাধীনতা লাভের পর ব্রিটিশ পার্লামেন্টে কোন আইন ওই দুই ডোমিনিয়নের বলবৎ থাকবে না। প্রতি ডোমিনিয়নের নির্বাচিত আইনসভা দেশের জন্য আইন রচনা করবে।
উপসংহার
ব্রিটিশ ভারতবাসী দীর্ঘদিনের নিরব বিচ্ছিন্ন সংগ্রামের কাছে শেষ পর্যন্ত মাথা নত করে। ভারতে নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য আগা করে ব্রিটিশ বিভাজন ও শাসন নীতি কায়েম রেখেছিল। এ দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার আগেই সেই নীতি প্রয়োগ করি তারা ক্ষমতা হস্তান্তর করে। ব্রিটিশের ঐকান্তিক চেষ্টায় অভাবে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুই আলাদা রাষ্ট্রের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়।