ক্ষমতা বা শক্তির (Power) সংজ্ঞা দাও। ক্ষমতার প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো। ই এইচ কার শক্তিকে ক-টি ভাগে ভাগ করেছেন? আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ক্ষমতার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করো।

ক্ষমতা বা শক্তির সংজ্ঞা

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তি বা ক্ষমতার (Power) ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক রাজনীতির মুখ্য উপাদান হল শক্তি। সাধারণভাবে শক্তি বা ক্ষমতা বলতে কোনো কিছু করার সামর্থ্যকে বোঝায়। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তা অন্য অর্থে ব্যবহৃত হয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশারদ হ্যান্স জে মর্গেনঘাউ তাঁর Politics Among Nations গ্রন্থে শক্তি বা ক্ষমতার সংজ্ঞা নির্দেশ করতে গিয়ে বলেছেন, শক্তি বা ক্ষমতা বলতে অন্যের মন ও কাজের ওপর নিয়ন্ত্রণকে বোঝায়। তাঁর মতে, এক জাতির মন ও কাজের ওপর অন্য জাতির ক্ষমতা বা শক্তি প্রয়োগ হল জাতীয় শক্তি (National power)|

ক্ষমতা বা শক্তির প্রকৃতি

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ কৌলম্বিস এবং উল্ফ তাঁদের An Intro- duction to International Relations গ্রন্থে এই অভিমত প্রকাশ করেছেনযে, অর্থনীতিতে সম্পদের যেমন গুরুত্ব, রাজনীতিতে ক্ষমতা বা শক্তির সেইরূপ গুরুত্ব। অবশ্য শক্তি ও বলপ্রয়োগ সমার্থক নয়। বলপ্রয়োগ বলতে কোনো জাতির সামরিক সামর্থ্যকে বোঝানো হয়। কিন্তু শক্তি বা ক্ষমতা আরও ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। শক্তির সঙ্গে শুধুমাত্র বলপ্রয়োগের মতো নেতিবাচক ধারণা জড়িত থাকে না, অনেক ইতিবাচক ধারণাও যুক্ত থাকে। যেমন, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে অথবা অর্থনৈতিক সাহায্য ও উন্নয়নমূলক প্রকল্পে সহযোগিতামূলক কাজকর্মের মাধ্যমে নিজের বক্তব্যের অনুকূলে অন্যকে নিয়ে আসা ইত্যাদি। অনেকে শক্তি ও প্রভাবকে সমার্থক মনে করেছেন। কিন্তু প্রভাব ও শক্তি সমার্থক নয়। কৌলম্বিস এবং উল্ফের মতে, শক্তি বা ক্ষমতা হল প্রভাব ও বলপ্রয়োগের মধ্যবর্তী একটি ধারণা। শক্তি বা ক্ষমতার সঙ্গে সামর্থ্যের বিষয়টিও জড়িত।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তি বা ক্ষমতার ধারণার সঙ্গে দুটি অনুমান যুক্ত রয়েছে। সেগুলি হল- ক্ষমতা বা শক্তি বলতে যুদ্ধ করার ক্ষমতা বা সামরিক সামর্থ্যকে বোঝায়। ② শক্তি বা ক্ষমতাকে পরিমাপ করা যায়।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞদের মতে, আধুনিক পারমাণবিক যুগে এই দুটি অনুমান অচল। অর্গানষ্কি প্রমুখের মতে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু বোধগম্যহীন উপাদান ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত থাকায় এর পরিমাপ করা কষ্টসাধ্য। তা ছাড়া বিভিন্ন দেশের সরকারের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সামরিক ক্ষমতার গুরুত্ব থাকলেও অসামরিক উপাদানের গুরুত্বও কম নয়।

বিশ্বরাজনীতিতে শক্তি বা ক্ষমতার ধারণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষমতাকে। কেন্দ্র করেই বিশ্বরাজনীতি আবর্তিত হয়। আর এই ক্ষমতার মাপকাঠিতেই বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রকে অতিবৃহৎ শক্তি, বৃহৎ শক্তি, মাঝারি শক্তি, ক্ষুদ্র শক্তি ইত্যাদি স্তরে বিনান্ত করা হয়।

শক্তি বা ক্ষমতার শ্রেণিবিভাজন

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শক্তি বা ক্ষমতার শ্রেণিবিভাজন করতে গিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিখ্যাত লেখক ই এইচ কার তিনটি প্রধান ক্ষমতার কথা উল্লেখ করেছেন। সেগুলি হল- [1] সামরিক শক্তি, [2] অর্থনৈতিক শক্তি এবং [3] জনমত গঠনের শক্তি।

[1] সামরিক শল্পি: আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটি রাষ্ট্র কতটা শক্তিশালী তা প্রধানত রাষ্ট্রের সামরিক শক্তির ওপর নির্ভর করে। অতীতের মতো বর্তমানেও যে রাষ্ট্র সামরিক শক্তিতে শক্তিশালী সেই রাষ্ট্রকে অতিবৃহৎ শক্তির (Super Power) মর্যাদায় ভূষিত করা হয়। জোশেফ ফ্র্যাঙ্কেল তাঁর Inter- national Relations গ্রন্থে বলেছেন যে, কোনো রাষ্ট্রের কামান ও বিমানের সামর্থ্য না থাকলে নরম ধাঁচের কূটনীতিও সফল হতে পারে না। [2] অর্থনৈতিক গন্ধি: আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সামরিক শক্তির মতো অর্থনৈতিক শক্তিও একটি বিচার্য বিষয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞদের মতে যুদ্ধ ও শান্তি যে সময়ই হোক না কেন, অর্থনৈতিক সামর্থ্যের প্রয়োজন রয়েছে। প্রতিরক্ষাজনিত প্রস্তুতি, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ, প্রযুক্তিবিদ্যা ও বৈজ্ঞানিক গবেষণার অগ্রগতি প্রভৃতি বিষয়ে অর্থনৈতিক শক্তি একান্ত আবশ্যক। এমনকি পররাষ্ট্রনীতির সাফল্যের জন্যও অর্থনৈতিক শক্তি বা ক্ষমতার প্রয়োজন আছে বলে অনেকে মনে করেন।

[3] জনমত গঠনের শক্তি: আধুনিককালে বিশ্বরাজনীতিতে কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে জনমত গঠনের বিষয়টিও শক্তি বা ক্ষমতার একটি উপাদানরূপে বিবেচিত হয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এটা দেখা গেছে, যে রাষ্ট্রের হাতে বিশ্বজনমত গঠনের ক্ষমতা রয়েছে সেই রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অধিকতর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ক্ষমতার গুরুত্ব ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক রাজনীতি চালিত হয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা নির্ধারণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল পারে না।

1 ] আন্তর্জাতিক রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তববাদী তত্ত্বের প্রবত্তাদের মতে, ক্ষমতা সম্পর্কিত ধারণা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে খুবই প্রাসঙ্গিক। জাতীয়তাবাদ ও সার্বভৌমত্বের মতো জাতীয় শক্তিকে তাঁরা রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে অভিহিত করেছেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তববাদী লেখকদের মতে, ক্ষমতা বা শক্তি হল এমন একটি মাধ্যম যার সাহায্যে কোনো রাষ্ট্র তার অভ্যন্তরীণ নীতি ও পররাষ্ট্রনীতিকে বাস্তবে প্রয়োগ করে থাকে। ক্ষমতা অর্জন, প্রয়োগ এবং তার প্রতিষ্ঠা হল আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয়। হ্যান্স জে মর্গেনথাউ তাঁর Politics Among Nations গ্রন্থে আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে ক্ষমতার লড়াই বলে আখ্যা দিয়েছেন।

2] রাষ্ট্রের প্রকৃতি নির্ধারণকারী: রাষ্ট্রের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা অক্ষুণ্ণ রাখার স্বার্থে ক্ষমতা বা শক্তির ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষণে রাষ্ট্রগুলিকে ‘শক্তি’ (Power) বলে অভিহিত করা হয়েছে। যেমন-ক্ষুদ্র শক্তি, মাঝারি শক্তি, বৃহৎ শক্তি ওঅতিবৃহৎ শক্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন অতিবৃহৎ শক্তি (Super power) হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবলুপ্তির পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একক মহাশক্তিধর রাষ্ট্ররূপে আবির্ভূত হয়েছে।

[3] পররাষ্ট্রনীতির প্রধান লক্ষ্য: রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাষ্ট্রগুলির পররাষ্ট্রনীতির প্রধান লক্ষ্য হল ক্ষমতা অর্জন করা। মর্গেনথাউ-এর মতে, শক্তিধর রাষ্ট্রগুলি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তাদের লক্ষ্যপূরণের জন্য ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটিয়ে থাকে। বস্তুত, ক্ষমতা অর্জন না করতে পারলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে তার অস্তিত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ছোটো-বড়ো প্রতিটি রাষ্ট্রের একমাত্র উদ্দেশ্য হল ক্ষমতা অর্জন করা।

Leave a Comment