ক্যান্টন বাণিজ্য
চিনে দক্ষিণ উপকূল অবস্থিত ক্যান্টন বন্দর বা ৬১৮-৯৬০ খ্রিস্টাব্দে থেকে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিল। প্রাচীন যুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত ক্যান্টন ছিল চীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র। নানকিং এর সন্ধির হাজার ৮৪২ খ্রিস্টাব্দে আগে পর্যন্ত গোটা চীন বিদেশের কাছ থেকে রুদ্ধ থাকলো একমাত্র ক্যান্টন ছিল বিদেশের কাছে উমুক্ত বন্দর। চীনা আদালত ১৭৫৯ খ্রিস্টাব্দে এক নির্দেশনামার দ্বারা একমাত্র ক্যান্টন বন্দরকে বিদেশি বাণিজ্যের জন্য খুলে দেয়। এভাবে ক্যান্টন বন্দরকে কেন্দ্র করে চীন বিদেশীদের এক বন্দর কেন্দ্রিক যে বাণিজ্য প্রথা সূচনা হয় তা ক্যান্টন বাণিজ্য প্রথা নামে পরিচিত। এই প্রথা ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দের নানকিং সন্ধি স্বাক্ষরিত হওয়ার আগে পর্যন্ত চলেছে। ক্যান্টনের বাণিজ্যের প্রথম পূর্বে পর্তুগিজরা এবং পরে ব্রিটেন সহ অন্যান্য ইউরোপীয় জাতি গুলি নিজেদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে।
ক্যান্টন বাণিজ্যের বৈশিষ্ট্য
১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে চীনে বিদেশীদের জন্য এক বন্দর কেন্দ্রিক ক্যান্টন বাণিজ্য শুরু হয়। ক্যান্টন বাণিজ্যের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়, যেমন –
১. রুদ্ধদ্বার নীতি
ক্যান্টন বাণিজ্যের অংশগ্রহণকারী বিদেশী বণিকদের চিনা ভাষা ও আদবকায়দা নিষিদ্ধ ছিল। তারা ক্যান্টনে চীনা ফৌজদারি ও বাণিজ্যিক আইন মেনে চলতে বাধ্য ছিল। দেশে বাণিজ্য কুঠিতে মহিলা ও আগ্নেয়স্ত্রের প্রবেশ, দাসি নিয়োগ প্রভৃতি নিষিদ্ধ ছিল। বাণিজ্যের মৌসুম শেষে ক্যান্টিনে আসা বিদেশি বণিকদের বাণিজ্যের মরশুম শেষে ক্যান্টিনে আসা বিদেশি বণিকদের এই বন্দর ছেড়ে চলে যেতে হতো। চীনে বিদেশি বণিকদের প্রতি এই কঠোর নীতির রুদ্ধ দ্বার নীতি নামে পরিচিত।
২. মূল শহরে প্রবেশে বাধা
ক্যান্টন বন্দরে বাণিজ্য করতে আসা ইউরোপীয় বণিকরা শহরে প্রধান ফটকের বাইরে একটি নির্দিষ্ট স্থানে বসবাস ও বাণিজ্যিক কার্যকলাপ চালাতে বাধ্য হত। তাদের কখনো ও প্রধান ফটক অতিক্রম করে মূল শহরে প্রবেশের অধিকার ছিল না। গনিদ্রা ক্যান্টন শহরে প্রাচীরের বাইরে বাস করলেও তাদের স্ত্রীর সন্তানের রেখে আসতে হতো ম্যাকাও এ।
৩. কো-হং প্রথা
বিদেশি বণিকরা চীনের ক্যান্টন বন্দরে এসে স্বাধীনতা বা সরাসরি এখানকার বাণিজ্যে অংশ নিতে পারত না। কেননা বিদেশি বণিকদের কোন অবস্থাতেই চীনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে দেয়া হতো না বা অন্য যে কোন বণিকের কাছ থেকেও সস্তা দরে তাদের মাল কেনার অধিকার ছিল না। চীন সরকার একমাত্র কো-হং নামক বণিক সংঘকে একচেটিয়া বাণিজ্য করার অধিকার দিয়েছিল এবং বিদেশি বণিকরা ক্যান্টন বন্দরকে একমাত্র কো-হং বণিকের কাছে থেকেই মাল কিনতে বাধ্য ছিল।
৪. ব্যক্তিগত বাণিজ্য
ক্যান্টনের একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার পেয়ে কো-হং অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। একচেটিয়া এই অধিকার পাওয়ার জন্য তারা চীন রাজ দরবার, আদালত ও শুল্ক অধিকর্তাকে বিপুল অর্থ উৎকোচন হিসেবে দিত। বিদেশীদের বাণিজ্যের শর্ত তারাই ঠিক করতো। এরপর বাণিজ্যের বেশিরভাগ লাভাংশ কো-হং বণিকরা আত্মসাৎ করত।
৫. ব্যক্তিগত বাণিজ্য
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সহ অন্যান্য ইউরোপীয় দেশীয় বণিকরা চীনের ক্যান্টন বন্দরের যে বাণিজ্য করত তা ছিল মূলত ব্যক্তিগত মালিকানা ভিত্তিক বাণিজ্য। এই বাণিজ্যের জন্য চীনের সঙ্গে বিদেশি বণিকদের কোন কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রয়োজন পড়তো না।
৬. ব্রিটিশ বণিকদের প্রাধান্য
ক্যান্টন বাণিজ্যের প্রথম দিকে পর্তুগিজরা প্রবেশ করলেও পরবর্তীকালে ব্রিটিশ বণিকরা এই বাণিজ্যের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। ক্যান্টনের ব্রিটিশ বণিকদের চায়ের বাণিজ্য সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ছিল। এছাড়া তারা রেশম, মৃৎপাত্র, দারুচিনি, ঔষধপত্র প্রভৃতি ইংল্যান্ডের রপ্তানি করতো। তারা ইংল্যান্ডের থেকে পসম বস্ত্র, লোহা, টিন, সিসা, পশুর লোম প্রভৃতি চিনে আমদানি করতো। চীনের সঙ্গে ইংল্যান্ডের এই বাণিজ্যিক দেশীয় বাণিজ্য নামে পরিচিত ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ক্যান্টন বাণিজ্যের আমেরিকার স্থান ছিল দ্বিতীয়।
উপসংহার
ব্রিটিশ মনিকা উনিশ শতকের প্রথম থেকে ভারত থেকে চোরা পথের চীনে আফিম রপ্তানি করতে থাকে। আফিমের ব্যবসা কে কেন্দ্র করে চীনের সঙ্গে ব্রিটেনের বিরোধের ফলে প্রথম আফিম যুদ্ধ বা প্রথম ইঙ্গ-চীন যুদ্ধ ১৮৩৯-৪২ খ্রিস্টাব্দে সংগঠিত হয়। এই যুদ্ধে চীনের পরাজয়ের ফলে ক্যান্টন ব্যবসা ভেঙে পড়ে। চীন ক্যান্টন সমাবেশ কয়েকটি বন্দর বিদেশি বণিকদের জন্য খুলে দিতে বাধ্য হয়। এভাবে ক্যান্টন বাণিজ্য প্রথার অবসান ঘটে।