কর্তা বলেন, সেইখানেই তাে ভূত | ওরে অবােধ, আমার ধরাও নেই ছাড়াও নেই, তােরা ছাড়লেই আমার ছাড়া | দেশের মধ্যে দুটো-একটা মানুষ | এখন কথাটা দাঁড়িয়েছে, ‘খাজনা দেব কিসে

“এখন কথাটা দাঁড়িয়েছে, ‘খাজনা দেব কিসে।”- কারা, কাদের কাছে খাজনা চেয়েছে? খাজনা দিতে না পারার কারণ কী?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্তার ভূত রচনায় খিড়কির আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়ায় ভূতের পেয়াদারা, আর অভূতের পেয়াদারা ঘুরে বেড়ায় সদরের রাস্তায়-ঘাটে।

গৃহস্থ দেশবাসীর কাছে উভয়ই খাজনা দাবি করে। রূপকের আড়ালে এখানে এই সত্য প্রকাশ করা হয়েছে যে, ধর্মতন্ত্র প্রতিনিয়ত দেশবাসীর কাছে যেমন ধর্মজীবনের খাজনা দাবি করে, আধুনিক জীবনও তেমনি তার কাছে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানরূপী খাজনা দাবি করে।

খাজনা প্রদানকারীদের অক্ষমতার কারণের একদিকে রয়েছে ধর্মতন্ত্রের সীমাহীন দাবি, যা কিছুতেই ধর্মভীরু দেশবাসীরা অগ্রাহ্য করতে পারে না।

অন্যদিকে রয়েছে খাজনা সংগ্রহের উদ্দশ্যে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ক্রমাগত আক্রমণ। তাই গৃহস্থের ঘরে এবং ঘরের বাইরে সব জায়গাতেই থাকা দায়।

এতদিন ধরে উত্তর দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম থেকে নানা জাতের বুলবুলি অর্থাৎ শক, হুন, পাঠান প্রভৃতি নানা বিদেশি লুণ্ঠনকারী এবং মােঘল ও ইংরেজ প্রভৃতি সাম্রাজ্যলােভী বিদেশি শক্তি দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে এদেশে এসেছে। তারা এখানকার ঐশ্বর্য-সম্পদ লুঠ করে নিয়ে গেছে, রিক্ত ভারতবাসীর তাই আর খাজনা দেওয়ার কোনাে ক্ষমতাই নেই।

“দেশের মধ্যে দুটো-একটা মানুষ” -এর সঙ্গে বুড়াে কর্তার কথােপকথন ‘কর্তার ভূত’ অবলম্বনে লেখো এবং রূপকার্থ আলােচনা করাে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কর্তার ভূত’ রচনায় দেখি যে, দেশের মধ্যে দুটো-একটা মানুষ দিনের বেলায় ভূতের নায়েবের ভয়ে চুপ করে থাকলেও গভীর রাতে তারা বুড়াে কর্তার দ্বারস্থ হয়। তাদের মুক্তি দেবার সময় কি তার তখনও হয়নি-হাতজোড় করে এ প্রশ্নই তারা বুড়াে কর্তাকে করে।

বুড়াে কর্তা এ কথা শুনে তাদের ‘অবােধ’ বলে সম্বােধন করে বলেন যে ধরা আর ‘ছাড়ার বিষয়টি তার উপর নির্ভর করে না।

অর্থাৎ তিনি ধরেন না তাই তাঁর ছাড়ার প্রশ্নও নেই। তারা বুড়াে কর্তাকে ছাড়লে তবেই তিনি আর নেই। সেকথা শুনে তারা জানায় যে, তেমনটা করতে তারা যে ভয় পায়। বুড়াে কর্তা তখন বলেন যে, সেই ভয়ের মধ্যেই ভূত অবস্থান করে।

এখানে ‘দেশের মধ্যে দুটো-একটা মানুষ’ হল তারাই যারা ভীরু দেশবাসী হয়েও আত্মশক্তিতে বলীয়ান হওয়ার চেষ্টা করে, আত্মকর্তৃত্ব লাভ করার ইচ্ছা প্রকাশ করে।

কিন্তু প্রাচীন সভ্যতার প্রেতযােনির মায়াজাল সম্পূর্ণরূপে ছিড়ে বেরিয়ে আসার সাহস বা আত্মবিশ্বাস তারা কিছুতেই শেষ পর্যন্ত অর্জন করতে পারে না।

কর্তার ইচ্ছায় কর্ম প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ তাই যথার্থই বলেছেন যে, “যখন আপন শক্তির মূলধন লইয়া জনসাধারণের কারবার না চলে, তখন সকল ব্যাপারেই মানুষ দৈবের কাছে, গ্রহের কাছে, পরের কাছে হাত পাতিয়া ভয়ে ভয়ে কাটায়।”

‘ওরে অবােধ, আমার ধরাও নেই ছাড়াও নেই, তােরা ছাড়লেই আমার ছাড়া’—এখানে কে কাদের অবােধ বলেছেন? উক্তিটির তাৎপর্য আলােচনা করাে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কর্তার ভূত’ গল্পে বুড়াে কর্তা দেশের দু-একজন লােককে উদ্দেশ্য করে মন্তব্যটি করেন।

দেশের মানুষ সাধারণভাবে ভূতের শাসনে নিশ্চিন্ত থাকলেও দু-একজনের ভাবনাচিন্তা একই খাতে চলে না। দিনের বেলায় যারা নায়েবের ভয়ে চুপ করে থাকে, তারাই রাতে বুড়াে কর্তার কাছে হাতজোড় করে দাঁড়ায়। তারা জানতে চায় যে, বুড়াে কর্তার তাদের ছেড়ে যাওয়ার সময় তখনও হয়নি কি না। তখনই বুড়াে কর্তা মন্তব্যটি করেন।

মানুষের ভয়ের মধ্যেই ভূতের অস্তিত্ব। সংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসকে আঁকড়ে থাকা মানুষ নিজের যুক্তিবুদ্ধিকে বিসর্জন দিয়ে এক পরাধীন জীবনযাপনকে পছন্দ করে।

সেখানে চোখ বুজে চলাই হচ্ছে জগতের সব চেয়ে আদিম চলা। যারা হুঁশিয়ার তারাই অশুচি। হুঁশিয়ারদের প্রতি উদাসীন থাকাটাই সেখানে রীতি।

ফলে ভূতের শাসন সর্বগ্রাসী হয়ে থাকে। মানুষ এর থেকে মুক্তি চায় না, বা মুক্তির কথা ভাবতে পারে না। স্বভাবদোষে যারা নিজস্ব ভাবনা ভাবতে যায়, তারাই ভূতের কানমলা খায়।

এইভাবে ভূতের শাসনের যে ধারাবাহিকতা তার অবসান ঘটা সম্ভব হয় না। মানুষের সংস্কার, অন্ধত্ব, আর তা থেকেই জন্ম নেওয়া ভয়কে অবলম্বন করে ভূতের শাসন চলতেই থাকে।

“কর্তা বলেন, সেইখানেই তাে ভূত।”- কোন প্রসঙ্গে এবং কেন কর্তা এ কথা বলেছেন?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কর্তার ভূত’ রচনায় আমরা দেখি যে, দেশের মধ্যে দুটো-একটা মানুষ দিনের বেলায় ভূতের নায়েবের ভয়ে চুপ করে থাকে।

কিন্তু তারাই গভীর রাতে বুড়াে কর্তার দ্বারস্থ হয়। তাদের মুক্তি দেবার সময় কি তার তখনও হয়নি-হাতজোড় করে এ প্রশ্নই তারা বুড়াে কর্তাকে করে। বুড়াে কর্তা এ কথা শুনে তাদের অবােধ সম্বোধন করে বলেন যে, তিনি তাদের যেমন ধরেও রাখেননি, তেমনি ছেড়েও দেননি।

তারা বুড়াে কর্তাকে ছাড়লে তবেই তিনি তাদের ছেড়ে চলে যাবেন। সেকথা শুনে তারা জানায় যে, তেমনটা করতে তারা যে ভয় পায়।

বুড়াে কর্তা সরাসরিই জানিয়েছেন যে, মানুষের মনের ভয়ের মধ্যেই ভূত অবস্থান করে। রবীন্দ্রনাথের মতে, আত্মশক্তি এবং আত্মবিশ্বাসের অভাবেই ভীত-সন্ত্রস্ত দেশবাসী আজ ‘পত্বপ্রাপ্ত’ ‘সর্বাঙ্গসম্পন্ন প্রাচীন সভ্যতার প্রেতযােনি আঁকড়ে রয়েছে’।

জনগণের ভয়ের কারণেই দেশে জীর্ণ ও অপ্রাসঙ্গিক ধর্মীয় সংস্কার ও ধর্মতন্ত্র বাসা বেঁধে রয়েছে। এই কারণেই বুড়াে কর্তা আলােচ্য উক্তিটি করেছেন। আমাদের সর্বাঙ্গসম্পন্ন পঞত্বপ্রাপ্ত প্রাচীন সভ্যতাই এই গল্পের ‘বুড়াে কর্তা’ এবং সে সভ্যতার ধর্মতন্ত্রই হল তার ভূত।

বাংলা সব প্রশ্ন উত্তর (একাদশ শ্রেণি)

Leave a Comment