এমন জবাব যদি আর-একটা শুনতে পাই তা হলে তােদের বুকে করে পাগলের মতাে নাচব | পৃথিবীতে জন্মেছি পৃথিবীকে সেটা খুব কষেবুঝিয়ে দিয়ে তবে ছাড়ি

“কিন্তু দেখছি হাজার বছরের নিষ্ঠুর মুষ্টি অতটুকু শিশুর মনকেও চেপে ধরেছে, একেবারে পাঁচ আঙুলের দাগ বসিয়ে দিয়েছে রে।”- বক্তা এই মন্তব্যের মধ্যে দিয়ে কী বলতে চেয়েছেন?

রবীন্দ্রনাথের ‘গুরু’ নাটকে দেখা যায়, অচলায়তনের উত্তরে যেহেতু একজটা দেবীর অবস্থান, তাই সেদিকের জানালা খােলা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল। সুভদ্র তার বালকসুলভ কৌতুহলে সেই তিনশাে পঁয়তাল্লিশ বছরের বন্ধ জানলা খুলে ফেলায় আয়তনের নিয়ন্ত্রকদের চোখে তা গুরুতর অপরাধ বলে বিবেচিত হয়। প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে তাকে হিঙ্গুমর্দনকুণ্ডে স্নান করার পর ছয়মাস ধরে অন্ধকার ঘরে মহাতামস ব্রত পালনের বিধানও দেওয়া হয়। কিন্তু আচার্য এবং পঞক চেয়েছিলেন উপাধ্যায় এবং মহাপঞকের এই নির্দেশকে প্রতিরােধ করতে। যদিও আয়তনের শিক্ষায় শিক্ষিত এবং সংস্কারে লালিত সুভদ্রের মনে হয়েছিল সে পাপ করেছে। তাই মহাতামস ব্রত পালনের জন্য সে নিজে থেকেই উদগ্রীব হয়ে ওঠে। উপাধ্যায় সুভদ্রের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান। আয়তনের অন্য অধিবাসীরা তার সম্পর্কে উচ্ছাস প্রকাশ করে। যদিও অচলায়তনের জীর্ণ প্রথার কাছে সুভদ্রের আত্মসমর্পণ আচার্যকে আহত করেছে। যুগ যুগ ধরে চলে আসা সংস্কার যেভাবে প্রাণের মুক্ত বিকাশকে ব্যাহত করে, তার কণ্ঠরােধ করে, তা উপলব্ধি করে আচার্য বেদনাহত হন।

সুভদ্রের উত্তর দিকের জানলা খােলাকে আচার্য কোনাে পাপ বলে মনে করেননি। ফলে সুভদ্রের প্রায়শ্চিত্তের বিরােধিতাও করেন তিনি। তাই প্রথার সঙ্গে প্রাণের দ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়ে ওঠে।

“পৃথিবীতে জন্মেছি পৃথিবীকে সেটা খুব কষেবুঝিয়ে দিয়ে তবে ছাড়ি।”- বক্তার এই মন্তব্যের তাৎপর্য আলােচনা করাে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গুরু’ নাটক থেকে নেওয়া প্রশ্নোধৃত অংশটির বক্তা প্রথম যূনক। অচলায়তনে মুক্ত প্রাণের প্রতীক পঞ্চকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল শূনকদের, তাদেরই পল্লিতে। তাদের জীবনের নিজস্ব ছন্দ পঞকেরও অপরিচিত ছিল। যূনকরা নাচতে পেলেই নাচে, গান তাদের কাছে মােটেও কোনাে মতিভ্রম নয়। তারা কোনাে গুরুকে মানে না, একমাত্র দাদাঠাকুরেই তাদের বিশ্বাস। এই যূনকরা অস্পৃশ্য বলে অচলায়তনের শাস্ত্রজ্ঞরা তাদের মন্ত্র দিতে চায় না। যূনকরা চাষ করে আনন্দ পায়। সাধারণ কাজের মধ্যেই তারা জীবনের সার্থকতা খুঁজে পায়। তাদের গানেও থাকে সেই কাজের আনন্দেরই উচ্চকণ্ঠ ঘােষণা—“আমরা চাষ করি আনন্দে। কাজের মধ্যেই মনের বিস্তার, আত্মার মুক্ত বিচরণকে খুঁজে পায় তারা। অচলায়তনের পুথিসর্বস্বতা আর সংস্কারনির্ভরতার বিপরীতে শূনকদের জীবনভাবনায় প্রকাশ পায় কাজের মধ্যে দিয়ে মানুষের আত্মপ্রতিষ্ঠার চিরন্তন বার্তা।

যুনকদের তাই কাকুড়ের বা খেসারি ডালের চাষ করতে কোনাে সংকোচ বােধ হয় না, লােহার কাজ করতেও তারা সমান নিঃসঙ্কোচ। এমনকি ক্ষৌরকর্ম করার সময় গাল কেটে গেলেও তারা সেদিন খেয়া নৌকোয় উঠে নদী পেরােতে ভয় পায় না। কাজের মধ্য দিয়েই তারা পৃথিবীর নাচের ছন্দে নিজেদের মিলিয়ে নেয়।

“এমন জবাব যদি আর-একটা শুনতে পাই তা হলে তােদের বুকে করে পাগলের মতাে নাচব…”— এ কথা বলার মধ্যে দিয়ে বক্তা কী বােঝাতে চেয়েছেন?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গুরু’ নাটকে শূনকদের সঙ্গে সাক্ষাতে তাদের ব্যতিক্রমী জীবনাচরণ বিস্মিত করে পঞ্জিকা। যূনকেরা চাষ করে, তার মধ্যে আবার উল্লেখযােগ্যভাবে কাকুড় আর খেসারি ডালের চাষ করে যা অচলায়তনের স্থবিরক সম্প্রদায়ের শাস্ত্র নিষিদ্ধ। কিন্তু যূনকদের সঙ্গে কথাবার্তায় অচলায়তনের অধিবাসী পঞ্চকের সেই শাস্ত্রীয় সংস্কার ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে শুরু করে। ক্ষৌরকর্মের সময় গাল কেটে রক্ত পড়লেও তাদের সেইদিন যে খেয়া নৌকায় উঠতে কোনাে বাধা থাকে না—তৃতীয় শূনকের মুখে এই কথা শুনে শিহরিত হয় পঞ্চক। যূনকদের লােহা পেটানাে তাকে আরও বিস্মিত করে। আর এই বিস্ময় সীমাহীন হয়ে ওঠে যখন পঞ্চক জানতে পারে যে, শূনকরা কেয়ূরী, মরীচী, মহাশীতবতী বা উয়ীষবিজয় কোনাে মন্ত্রই জানে না। যে পঞ্চক অচলায়তনের ভিতরে ছিল প্রথা আর সংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক, সেই পঞ্চ কই কিছুটা মানসিক জড়তা সত্ত্বেও শূনকদের মধ্যে খুঁজে পায় তার আদর্শের বিকাশ। ফলে এক প্রবল আনন্দের উচ্ছাস তৈরি হয় তার মনে। জীবনবােধের সেই সাদৃশ্যের জায়গা থেকেই পঞ্চক প্রশ্নোষ্বৃত মন্তব্যটি করে। বােঝা যায়, মুক্ত জীবনের স্বাদ মানুষের প্রথাবদ্ধ জীবনেও কীভাবে মুহূর্তমধ্যে পরিবর্তনের জোয়ার আনতে পারে, মানুষকে আরও উদার করে তুলতে পারে।

বাংলা সব প্রশ্ন উত্তর (একাদশ শ্রেণি)

Leave a Comment