উৎপল দত্তের নাটক | নাট্যকার উৎপল দত্তের পরিচয় | নবনাট্য-আন্দোলন | শুরু থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত বাংলা যাত্রাপালার ক্রম ইতিহাস

নাট্যকার উৎপল দত্তের সংক্ষিপ্ত পরিচয়

সাধারণভাবে উৎপল দত্ত (১৯২৯-১৯৯৩ খ্রি.) একজন উচ্চমানের অভিনেতা হিসেবে বেশি পরিচিত হলেও তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট নাট্যকার এবং উঁচু দরের নাট্যবােদ্ধা। নট ও নাট্যকার উৎপল দত্ত ছাত্রাবস্থায় ‘দি অ্যামেচার শেকসপিরিয়ানস’ নামে একটি থিয়েটারের দল গঠন করেন, পরে যার নাম হয় ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’। প্রথম দিকে তিনি ইংরেজি নাটকের প্রযােজনা ও অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও পরবর্তীকালে তিনি গণনাট্য সংঘে যােগ দেন।

উৎপল দত্ত একদিকে যেমন বিদেশি নাটকের অনুবাদ করেছেন, অন্যদিকে তেমনি মৌলিক নাটকও রচনা করেছেন। ‘ম্যাকবেথ’, ‘ওথেলাে’, ‘জুলিয়াস সিজার’, ‘সমাধান’ প্রভৃতি তাঁর অনূদিত নাটক ; ‘ছায়ানট’, ‘অঙ্গার’, ‘টোটা’, ‘তিতুমীর’, ‘টিনের তলােয়ার’, ‘মানুষের অধিকার’, ‘ব্যারিকেড’, ‘ফেরারী ফৌজ’, ‘কল্লোল’, ‘তীর’, ‘শৃঙ্খল ঝঙ্কার’, ‘পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস’, ‘নীল সাদা লাল’, ‘লাল দুর্গ’, ‘জনতার আফিম’ প্রভৃতি তাঁর মৌলিক নাটক। এইসব নাটকে উৎপীড়িত মানুষের যন্ত্রণা ও প্রতিবাদ মূর্ত হয়ে উঠেছে।

উৎপল দত্তের নাটকগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয়

গণমুখী চেতনা নিয়ে উৎপল দত্ত নাটক ও যাত্রাপালা লিখেছিলেন। বিহারের ধানবাদ অঞ্চলের কয়লাখনি দুর্ঘটনাকে অবলম্বন করে লেখা ‘অঙ্গার’, ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লবী আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা ‘ফেরারী ফৌজ’ বা ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের নৌবিদ্রোহের পটভূমিকায় লেখা ‘কল্লোল’ উৎপল দত্তকে বাংলা নাটকে চিরস্থায়ী জায়গা দিয়েছে।

তাঁর ‘টিনের তলােয়ার’ নাটকে উনিশ শতকের আমােদপ্রিয় ‘বাবু’-দের বিরুদ্ধে মঞশিল্পীদের প্রতিবাদের কাহিনি প্রতিফলিত হয়েছে। ‘ছায়ানট’ নাটকে চিত্রনির্মাতাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা, ‘ব্যারিকেড’ নাটকে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে কমিউনিস্টদের আত্মরক্ষার ইতিহাস, ‘তীর’, ‘তিতুমীর’ ও ‘টোটা’ নাটকে যথাক্রমে আদিবাসী বিদ্রোহ, ফকির বিদ্রোহ ও সিপাই বিদ্রোহ বর্ণিত হয়েছে। স্বাধীনতার স্বপ্নপূরণে অক্ষম ভারত সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের মনে জমে ওঠা ক্ষোভ এবং শাসকদের দমন-পীড়নকে অবলম্বন করে রচিত তাঁর ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’ নাটকটি একসময় নিষিদ্ধ ঘােষিত হয়েছিল।

উৎপল দত্ত প্রকৃত অর্থেই গণনাট্য-আন্দোলন পরবর্তী নবনাট্য-আন্দোলনে গতি সঞ্চার করেছিলেন। নাটককে শুধু শিল্পরূপে দেখেননি তিনি, নাটক তাঁর কাছে হয়ে উঠেছিল আন্দোলনের, প্রতিবাদের, প্রতিরােধের অন্যতম হাতিয়ার। বাংলা নাটক ও রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে তিনি অভিনেতা হিসেবে যেমন, তেমনি নাট্যকার এবং নাট্যবােদ্ধা হিসেবেও স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

শুরু থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত বাংলা যাত্রাপালার ক্রম ইতিহাস বিবৃত করাে।

বাংলা সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন ‘চর্যাপদ’-এ ‘বুদ্ধনাটক বিষম হোই’ পদে যে নাট্যরীতির উল্লেখ আছে, তা যাত্রারই সমধর্মী। বাংলা ভাষার আদি-মধ্য যুগের একমাত্র নিদর্শন ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে তিনটি চরিত্রের উক্তি-প্রত্যুক্তিমূলক যে ‘বিথী’ নাটকের উল্লেখ আছে, সেটিও যাত্রার আঙ্গিকের প্রায় কাছাকাছি। চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পর বাংলাদেশ জুড়ে কৃষ্ণযাত্রা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল, যা অষ্টাদশ শতকের শেষে এসে নিম্নরুচি ও স্থুল ভাঁড়ামিতে পর্যবসিত হয়েছিল। রাজেন্দ্রলাল মিত্রের বয়ান থেকে জানা যায়, শিশুরাম অধিকারী এবং তাঁর দুই শিষ্য শ্রীদাম ও সুবলের চেষ্টায় আবার যাত্রার সুদিন ফিরে আসতে থাকে। এই সময় বাংলাদেশে কৃষ্ণযাত্রার পাশাপাশি লােকপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে ভারতচন্দ্রের সৃষ্টি অবলম্বনে বিদ্যাসুন্দর যাত্রাপালা।

গােবিন্দ অধিকারীর হাতে যাত্রা আবার তার পুরােনাে জৌলুশ ফিরে পেতে শুরু করে। নতুন রুচির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তিনি পালা-নাটকের অঙ্কভাগ করলেন, কিন্তু দৃশ্যভাগ করলেন না। এরপর কৃষ্ণকমল গােস্বামী ভক্তিরস প্রসারের উদ্দেশ্যে কৃষ্ণযাত্রাকে নতুন ছাঁদ দিলেন। পরবর্তীকালে ‘বিদ্যাসুন্দর যাত্রাপালাকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছে দেন গােপালচন্দ্র দাস, যিনি গােপাল উড়ে নামেই সমধিক পরিচিত। এই সময়ের কয়েকজন উল্লেখযােগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন বকু মিঞা, সাদের মিঞা, ঝড়ুদাস অধিকারী, হরিনাথ মজুমদার প্রমুখ। পরবর্তী সময়ে মতিলাল রায় যাত্রাকে অশ্লীলতা বা নিম্নরুচির হাত থেকে উদ্ধার করে লােকশিক্ষার বাহন হিসেবে নিযুক্ত করেন।

নবনাট্য আন্দোলনের জন্মকথা উল্লেখ করে এই নাট্য আন্দোলনের পরিচয় দাও।

একঘেয়ে মার্কসীয় আদর্শ প্রচার থেকে মুক্তি পেতে মূলত শম্ভু মিত্রের উদ্যোগে বাংলা নাট্য আন্দোলনে যুক্ত হল নবনাট্য আন্দোলন।

নবনাট্য-আন্দোলন: গণনাট্যের পরবর্তী পর্যায় হল নবনাট্য- আন্দোলন। নবনাট্যের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে হলে গঙ্গাপদ বসুর কথাতেই বলতে হয়—“সৎ মানুষের নতুন জীবনবােধের এবং নতুন সমাজ ও বলিষ্ঠ জীবনগঠনের মহৎ প্রয়াস যে সুলিখিত নাটকে শিল্প সুষমায় প্রতিফলিত, তাকেই বলতে পারি নবনাট্যের নাটক এবং এইরকম নাটক নিয়ে মঞ্চে সমাজ-সচেতন শিল্পীর মতাে রিয়ালিটির যে অন্বেষণ তাকেই বলতে পারি নবনাট্য আন্দোলন।” বস্তুতপক্ষে, নাটক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়ে গণনাট্যের সঙ্গে নবনাট্যের তেমন কোনাে বৈসাদৃশ্য লক্ষ করা না গেলেও একটি বিষয়ে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য দেখা গিয়েছিল। সেটি হল, নবনাট্যের দলগুলি বিশেষ কোনাে রাজনৈতিক মতাদর্শের মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ করতে চাননি। নবনাট্যের সূত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ্য হলেন নাট্যাচার্য শম্ভু মিত্র (‘চাদবণিকের পালা’), তৃপ্তি মিত্র (‘বিদ্রোহিণী’), উমানাথ ভট্টাচার্য (‘ছারপােকা’) প্রমুখ।

বাংলা সব প্রশ্ন উত্তর (একাদশ শ্রেণি)

Leave a Comment