উপনিবেশিক আমলে ভারতে বিভিন্ন উদ্যোগে রেলপথের সম্প্রসারণ সম্পর্কে আলোচনা করো?

ভারতের রেলপথের সম্প্রসারণ

ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের রেলপথের প্রতিষ্ঠা ও সম্প্রসারণ আধুনিক ভারতের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে থেকে শুরু করে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে ভারতে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মধ্যে রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়। এই সময়কালে ভারতের রেলপথ সম্প্রসারণ এর ক্ষেত্রে চারটি পৃথক পর্যায়ে লক্ষ্য করা যায়, যথা – ১. গ্যারান্টি ব্যবস্থা, ২. সরকারি উদ্যোগ, ৩. পুনরায় গ্যারান্টি ব্যবস্থা, ৪. পুনরায় সরকারি উদ্যোগ। এই পর্যায়ে গুলি সম্পর্কে নীচে আলোচনা করা হলো-

১. গ্যারান্টি ব্যবস্থা

ভারতের রেলপথ নির্মাণে কোম্পানিগুলিকে উৎসাহ দেওয়ার উদ্দেশ্য সরকার কয়েকটি বিষয় কোম্পানিগুলোকে গ্যারান্টি বা প্রতিশ্রুতি দেয়। এই ব্যবস্থা গ্যারান্টি ব্যবস্থা নামে পরিচিত।

(১) গ্যারান্টি ব্যবস্থার শর্ত : গ্যারান্টি ব্যবস্থা প্রধান শর্ত গুলি ছিল- (i) সরকার কোম্পানিগুলিকে রেলপথ নির্মাণের জন্য বিনামূল্যে জমি দেবে। (ii) কোম্পানিগুলি বিনিয়োগ করা মূলধনের ওপর বার্ষিক পাঁচ শতাংশ হারের সুদ দেবে। (iii) সুদ পরিশোধের পর লাভ্যাংশ সরকার ও কোম্পানির মধ্যে সমানভাবে ভাগ করা হবে। (iv) সরকার ইচ্ছা করলে ২৫ বা ৫০ বছর পর রেলপথ গুলি ক্রয় করতে পারবে।

(২) গ্যারান্টি ব্যবস্থার প্রয়োগ : সরকারি গ্যারান্টি পাওয়ার পর আটটি ব্রিটিশ কোম্পানি ভারতের রেলপথ স্থাপনের মূলধন বিনিয়োগ করে। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত ভারতে ৪, ২৫৫ মাইল রেলপথ নির্মিত হয়।

(৩) দুর্নীতি : লাভের গ্যারান্টি থাকা কোম্পানিগুলি ইচ্ছাকৃতভাবে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি খরচ করতে থাকে এবং তাদের বার্ষিক হিসাবে প্রচুর ঘাটতি দেখায়। এভাবে রাজস্ব থেকে এই ঘাটতি মেটানো হতো। এর ফলে এই প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠে।

২. সরকারি উদ্যোগ

গ্যারান্টি ব্যবস্থায় নানা দুটি দেখা দেওয়ায় সরকার এই ব্যবস্থা বাতিল করে নিজের হাতে রেলপথ নির্মাণের দায়িত্ব নেয়। সরকারি উদ্যোগে ১৮৬৯ থেকে ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বেশ কিছু রেলপথ নির্মিত হয়। এর ফলে কোম্পানিগুলির মুনাফা হার লাভের পথ বন্ধ হয়। তারা পার্লামেন্টে সরকারি উদ্যোগে রেলপথ নির্মাণের বন্ধের দাবি জানান। এই সময় ভারতে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ও দ্বিতীয় আফগান যুদ্ধে (১৮৭৮ ও ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে) ফলে সরকারের আর্থিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে সরকারি উদ্যোগের রেলপথ নির্মাণ বন্ধ হয়ে যায়।

৩. পুনরায় গ্যারান্টি ব্যবস্থা

রেলপাড় নির্মাণের জন্য ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় গ্যারান্টি ব্যবস্থা চালু হয়।

(১) নতুন গ্যারান্টি ব্যবস্থার নীতি : (i) রেলপথ নির্মাণে পরিকল্পনার দায়িত্ব থাকে সরকারের হাতে। কোম্পানিগুলি শুধু রেলপথ নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। (ii) পূর্ববর্তী পাঁচ শতাংশের পরিবর্তে বর্তমান ব্যবস্থায় ৩৫ শতাংশ সুদের হার গ্যারান্টি দেওয়া হয়।

(২) রেলপথের প্রসার : এই ব্যবস্থায় কোম্পানিগুলি প্রচুর লাভবান হয়। তবে 1905 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতের প্রায় ২৮ হাজার মাইল রেলপথ নির্মিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতের রেলের উন্নয়ন কিছুটা ব্যাহত হয়।

(৩) রেলবোর্ড গঠন : ভারতীয় রেল ব্যবস্থায় পরিচালনার জন্য ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে রেল বোর্ড গঠন হয়। এরপরের রেল ব্যবস্থা আরো সম্প্রসারিত হয়।

(৪) অ্যাক‌ওয়ার্থ কমিটি : রেলপথের সম্প্রসারণ ও রেল প্রশাসনের সংস্কারের উদ্দেশ্যে স্যার উইলিয়াম অ্যাক‌ওয়ার্থ এর সভাপতিত্বে ‘অ্যাক‌ওয়ার্থ কমিটি’ (১৯২১ খ্রিস্টাব্দে) নামে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি নিযুক্ত হয়। এই কমিটির রেল পথের উন্নয়নের উদ্দেশ্যে প্রতি পাঁচ বছরের দেড়শ কোটি টাকা বিনিয়োগ, পৃথক বাজেট, সরকারি নিয়ন্ত্রণের রেলপথ নির্মাণ প্রভৃতি প্রস্তাব দেয়। কিন্তু সরকার তখন এই প্রস্তাব গ্রহণ করেননি।

৪. পুনরায় সরকারের উদ্যোগ

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৮৪১-১৮ খ্রিস্টাব্দে) সময় থেকে ভারতীয় নেটটি বিন্দু রেল ব্যবস্থায় বেসরকারি উদ্যোগ, ভারতীয় যাত্রীদের প্রতি দুর্ব্যবহার ভারতীয় পণ্যের উপর বাড়তি মাশুল প্রভৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। এই অবস্থায় ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে সরকার কয়েকটি রেল কোম্পানির দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেয়। রেলবোট পুনর্গঠিত হয় এবং পৃথক রেল বাজেট তৈরি হয়। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত মূলত এই ব্যবস্থায় কার্যকর ছিল।

উপসংহার

ঐতিহাসিক বীপাণ চন্দ্র বলেছেন, “রেলপথের প্রতিষ্ঠার ফলে ভারতীয় জনগণের জীবন, সংস্কৃতি অর্থনীতির বৈপ্লবিক প্রভাব পড়েছিল।”ভারতীয়দের পক্ষে রেলপথের সম্প্রসারণ সুফল ও কুফল উভয় নিয়ে এসেছিল। রেলপথের মাধ্যমে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা বৈপ্লবিক অগ্রগতি ঘটেছিল, আধুনিক শিল্প ও বাণিজ্যের বিকাশ সম্ভব হয়েছিল এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছিল। তবে রেলপথের দ্বারা ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে ব্রিটিশদের শোষণ শিক্ষার ছড়িয়ে পড়েছিল।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment