উপনিবেশবাদ ও নয়া উপনিবেশবাদের মধ্যে পার্থক্য লেখ? নয়া উপনিবেশবাদের ফলাফল লেখ?

উপনিবেশবাদ ও নয়া উপনিবেশবাদের পার্থক্য সমূহ

উপনিবেশবাদ

১. উৎসগত : উপনিবেশবাদ কথাটি এসেছেন ল্যাটিন শব্দ Colonia থেকে যার অর্থ হলো বিশাল সম্পত্তি বা এস্টেট। নৌ শক্তিতে শক্তিশালী ইংল্যান্ড, স্পেন, পর্তুগাল, ফ্রান্স, হল্যান্ড ইত্যাদি দেশগুলি এশিয়া, আফ্রিকা সর্বপ্রথম উপনিবেশ স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিল।

২. সংজ্ঞাগত : সাধারণভাবে বলা যায় কোন দেশ যদি অন্য দেশের ভূখণ্ড বাঞ্চলকে নিজের অধীনস্থ করে নেয় তাহলে সেই অঞ্চলটির নাম হয় উপনিবেশ। Encyclopedia of Social sciences ‘ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে উপনিবেশবাদ হল অন্য দেশের ভৌগোলিক অঞ্চলের ওপর শাসন প্রতিষ্ঠা করে ধীরে ধীরে সেখানকার অর্থনীতি, রাজনীতি, সভ্যতা ও সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণে আনা।

৩. প্রকৃতিগত : প্রকৃতির বিচারে উপনিবেশবাদে তিনটি রূপ প্রত্যক্ষ করা যায়, যথা- সাময়িক বা রাজনৈতিক রূপ, অর্থনৈতিক রূপ ও সংস্কৃতি রূপ। এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাদ্দিন আমেরিকা বিভিন্ন দেশগুলিতে ব্রিটিশ, ফরাসি, ওলন্দাজ, স্পেনীয় নাবিকগণ প্রথমে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে অনুপ্রবেশ করে। পরবর্তী সময়ে ঐ সমস্ত বণিক কোম্পানিগুলি এবং ওই দেশের বাণিজ্য লিপ্ত দেশগুলোতে উপনিবেশ গড়ে তোলে। ফলে বাণিজ্যে লিপ্ত স্বাধীনতা হারায় এবং সেগুলি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উপনিবেশ রূপান্তরিত হয়।

৪. প্রভাব গত : উপনিবেশিক বাদে প্রভাবে একদিকে যেমন বাণিজ্যিক শক্তি গুলির শাসক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়, অপরদিকে তেমন স্বাধীন দেশগুলি উপনিবেশের রূপ নেয়। উপনিবেশগুলি থেকে ঔপনিবেশিক শক্তি একনাগাড়ে অর্থ ও সম্পদ লুণ্ঠন করে। সার্বিক শোষণ আর স্বৈরাচারী শাসনের লক্ষ্যে উপনিবেশের উপনিবেশিক শক্তি নিজের স্বার্থে নানা ধরনের দমনমূলক আইন প্রবর্তন করে এবং গণতন্ত্রের কন্ঠ রোধ করে। উপনিবেশবাদী নীতি সমূহ থেকে পরবর্তীকালে সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভব ঘটে।

নয়া উপনিবেশবাদ

১. উৎসগত : ‘Neo’ শব্দের অর্থ হলো নয়া বা ন্যব আর Colonialism -এর অর্থ হলো উপনিবেশবাদ। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকা পরাধীন দেশগুলি উপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি হয় কিন্তু ওই সমস্ত সদ্য স্বাধীন দেশগুলি নিরাপত্তা, শিল্পায়ন, অর্থনৈতিক অগ্রগতি প্রভৃতির প্রয়োজনে বিশ্বের উন্নত শক্তিধর দেশগুলির সাহায্য গ্রহণ করলে নয়া উপনিবেশবাদ উত্থান ঘটে।

২. সংজ্ঞাগত : নয়া উপনিবেশবাদ হলো উপনিবেশবাদের আধুনিক রূপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন পরাধীন দেশগুলি ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু পুরনো ঔপনিবেশিক শক্তি গুলি এই সমস্ত সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশগুলিতে আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সংস্কৃতিক দেশ গুলিতে উন্নতির প্রয়োজনে সাহায্য ধানের মাধ্যমে যে অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে তা হল নয়া উপনিবেশবাদ।

৩. প্রকৃতিগত : নয়া উপনিবেশীবাদের উপনিবেশের অস্তিত্ব থাকে না, কিন্তু পরোক্ষভাবে অনুন্নত ও দুর্বল দেশ বলে উন্নত ও ধনী দেশগুলির কাছে আর্থিক ঋণ, প্রযুক্তিগত সাহায্য প্রভৃতি গ্রহণ করার স্বাধীনতা হারায়। তাই অনেক প্রকৃতিগতভাবে নয়া উপনিবেশবাদ কে আনুষ্ঠানিকতা হীন উপনিবেশ বা অদৃশ্য সাম্রাজ্যবাদ আখ্যা দেন। অনেক সময় সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির কাছে দুর্বল দেশ গুলি বা তার সরকার সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, এমনকি নিজের ভূমিতে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির সামরিক ঘাটে নির্মাণেরও অনুমতি দিতে বাধ্য হয়।

৪. প্রভাবগত : নয়া উপনিবেশবাদের প্রভাবে আপাত স্বাধীন দেশগুলি প্রকৃত অর্থ স্বাধীনতা হারায়। চড়া হারে সুদের বিনিময়ে ঋণ গ্রহণ করার অর্থনীতি পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আর্থিকভাবে প্রধানত হওয়ার পর ঋণদানকারী রাষ্ট্রের কাছে ঋণ গ্রহণকারী রাষ্ট্রের নিজস্ব রাজনৈতিক এবং সামরিক নিয়ন্ত্রণ বন্ধ হোক রাখতে হয়। অনেক সময় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নিজেও স্বার্থের ঋণ গ্রহণকারী রাষ্ট্রে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করে। আর্থিক ঋণ গ্রহণের পাশাপাশি প্রযুক্তিগত বা কারিগরি কলা কৌশল্যগত সাহায্য নেওয়ার ঋণ গ্রহণকারী রাষ্ট্রগুলি সম্পূর্ণ রূপের ঋণদানকারী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও অধীনস্থ হয়ে পড়ে।

নয়া উপনিবেশবাদের ফলাফল

আধুনিক বিশ্বের নয়া উপনিবেশবাদের বেশ কিছু প্রভাব লক্ষ্য করা যায়-

১. অর্থনীতিতে

দ্রুত উন্নয়নের লক্ষ্যে অনুন্নত দেশগুলি উন্নত রাষ্ট্রগুলির কাছে থেকে উচ্চ সুদের বিনিময়ে অর্থ ঋণ নেয়। GATT (General Agreement on Tariff and Trade) চুক্তি স্বাক্ষরের ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের পর তৃতীয় বিশ্বে লগ্নীর পরিমাণ আরো বেড়েছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশ বলি অর্থনীতির মূলত কৃষির ওপর নির্ভরশীল। তাই তারা শিল্পের স্বয়ম্ভর হয়ে উঠলে পুঁজিবাদী দেশগুলির রপ্তানি বাণিজ্যের হার কমবে, এইভাবে শিল্পোন্নত দেশগুলি GATT (১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে) যা পরবর্তীকালে প্রবর্তিত হয়ে হয় WTO (World Trade Organisation) এবং বিশ্বায়ন প্রভৃতি সাহায্যে আর্থিক শোষণ শুরু করে।

২. রাজনৈতিক ক্ষেত্র

নয়া উপনিবেশবাদের দ্বারা সরাসরি রাজনৈতিক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত না হলেও পরোক্ষভাবে অনুন্নত, দুর্বল এবং আর্থিক সাহায্য গ্রহণ কারী দেশগুলি রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। নয়া উপনিবেশবাদের শক্তিশালী দেশ গুলি অনুন্নত দেশগুলি উন্নয়নে নামে সেই দেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে। সে দেশে সরকার সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরোধিতা করলে শাসক দলকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করা হয়। এক্ষেত্রে বহুজাতিক সংস্থাগুলি দ্বারা বিরোধী রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে মদত দেওয়া হয়, জাতের শাসক দল ক্ষমতা চ্যুত হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় হাজার ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিল কিলটনের প্রশাসন মার্কিন স্বার্থ বিরোধী হাইতিল সেডার্স সরকারকে ক্ষমতা চউত্য করে।

৩. সামরিক ক্ষেত্র

নয়া উপনিবেশবাদী শক্তি সামরিক চুক্তি সম্পাদন এবং সামরিক জোট গঠনের দ্বারা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে সচেষ্ট হয়। সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকান দেশগুলিকে নিয়ে একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অপরদিকে সৌভিয়েত ইউনিয়নের জোট গঠনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশগুলোর সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি গুলির সহাবস্থান নয়া উপনিবেশবাদের এক দ্রুত কৌশল ছাড়া আর কিছুই নয়। অনেক সময় সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থচরিতার্থের লক্ষ্যে নিরাপত্তার অজুহাতে সুবিধা জনক দুর্বল দেশগুলিতে বৃহৎ শক্তি দেওয়ার দেশগুলি সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করে।

৪. অন্যান্য

(১) অনেক সময় উন্নত দেশগুলি অনুন্নত দেশগুলির উন্নয়ন ঘটানোর নামে অর্থের বিনিময়ে যুক্তিগত বা কলা কৌশল্যগত সাহায্য দেয়। এক্ষেত্রে দেখা যায় পশ্চিমী দেশগুলোতে বাতিল হয়ে যাওয়া কৌশল বা প্রযুক্তির অধিকতর দামে অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলিতে বিক্রি করা হয়।

(২) উন্নয়নশীল দেশগুলোর সরকার শিক্ষা খাতে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করলে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বা গবেষণার জন্য উন্নত পরিকাঠামোর অভাবে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা উন্নত দেশগুলিতে চলে যায়। ফলস্বরূপ উন্নয়নশীল দেশগুলি এদেশে গবেষণা লব্ধ ফলাফল থেকে বঞ্চিত হয়।

(৩) অনেক সময় নয়া উপনিবেশবাদী শক্তি গুলি অনুন্নত দেশগুলি শিক্ষা সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণের দ্বারা সেই দেশকে নিজের অধীনে আনে। বিভিন্ন শিক্ষা কার্যক্রম প্রবর্তন এবং সংস্কৃতি আদান-প্রদানের আলারে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশগুলির অতীত ঐতিহ্য সংস্কৃত থেকে ধ্বংস করে।

৫. ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রসার

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে উপনিবেশিক শাসনের আবাসনের মাধ্যমে বহু স্বাধীন রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ ঘটেলে এসব দেশের রুশো মার্কিন ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রসার ঘটে। কোন বৃহৎ যুদ্ধের পরিবর্তে রাশিয়া ও মার্কিন সাম্রাজ্য তাদের উন্নত মনস্তত্ত্ব ও যুক্তিবাদের সাহায্য রাজনৈতিক, শ্যামরি ও আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে সদ্যসাধীন দেশগুলোতে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালায়। বৃহত্তর শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের উদ্দেশ্যে সদ্য স্বাধীন দেশগুলি রাশিয়া ও আমেরিকান ঠান্ডা লড়াইয়ের কেন্দ্রে পরিণত হয়।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment