সূচনা : উনিশ শতকে বিশ্ব রাজনীতির এক প্রধান বৈশিষ্ট্য হল ইউরোপের বাইরে ইউরোপীয় সীমানার বিস্তৃতি। পঞ্চদশ শতক থেকে মূলত ক্রিস্টোফার কলম্বাস, ভাস্কো-দা-গামা, ভাস্কো নুনেজ বালবোয়া, আমেরিগো ভেসপুচি প্রমুখের প্রচেষ্টায় বিশ্বের ভৌগোলিক আবিষ্কার সম্ভব হয়। এর ফলে ইউরোপের দেশগুলি বহিঃইউরোপে ও ব্যবসা-বাণিজ্য ও ধর্ম প্রচারের সুযোগ পায়। সামুদ্রিক পাথরে আবিষ্কারের ফলে বিশ্বের কোন আর দূরে রইল না। উনিশ শতকের শেষে ব্রিটিশ, ফরাসি, পর্তুগিজ, স্পেনীয়, ডাচ বা ওলন্দাজগণের প্রোচেষ্টায় একের পর এক উপনিবেশ গড়ে উঠতে শুরু করে। এই ঔপনিবেশিক প্রতিযোগিতায় পরবর্তীকালে জার্মানি, রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সামিল হয়।
ইউরোপীয় রাষ্ট্র সমূহের উপনিবেশ বিস্তার
১. ব্রিটিশদের উপনিবেশ
ব্রিটিশরা অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, ভারত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে নিজেদের উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল এবং সাম্রাজ্যবাদের প্রসার ঘটিয়েছিল।
(১) অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড : ব্রিটিশ নাবিক ক্যাপ্টেন কুক অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি বোটানি হ্রদ-এ সর্বপ্রথম ব্রিটিশ পতাকা উড়ান। ওয়েকফিল্ড এর নেতৃত্বে বহু ইংরেজ নিউজিল্যান্ডে এসে বসবাস শুরু করেন।
(২) কানাডায় : কানাডায় প্রথম দিকে ফরাসিদের অনুপ্রবেশ ঘটলেও এখানে ব্রিটিশরা সুযোগ বুঝে প্রবেশ করে এবং বল প্রয়োগের মাধ্যমে এখানকার কুইবেক অঞ্চলকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ভুক্ত করে।
(৩) ভারত : বাণিজ্য লক্ষ্য নিয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে পা রাখে। পরবর্তীকালে পলাশীয় বক্সারের যুদ্ধে জিতে এবং দেওয়ানী লাভের মাধ্যমে ব্রিটিশ বণিক কোম্পানি এ দেশের শাসন নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। সিপাহী বিদ্রোহের পর ইংল্যান্ডের রানী ও পার্লামেন্টের ভারতের কোম্পানি শাসনের আবাসন ঘটায়, শুরু হয় ব্রিটিশ সরকারের শাসন। দীর্ঘ সংগ্রামের পর অবশেষে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত বর্ষকে ভারত ও পাকিস্তানের নাম দুই আলাদা করে রাষ্ট্র ভাগ করে স্বাধীনতা দেওয়া হয়।
(৪) দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় : দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সিংহল, সিঙ্গাপুর, মালকা এবং ফিজি দ্বীপপুঞ্জ ও ব্রিটিশ সরকার নিজের দখলে আনে, দক্ষিণ আফ্রিকায় নাটাল, অরেঞ্জ, স্টান্সভাল, সুদান, উগান্ডা, বেচুয়ানাল্যান্ড, জেডিসিআর ইত্যাদি অঞ্চলের ওপর ইংল্যান্ড নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।
২. ফরাসিনের উপনিবেশ : অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়কালে সপ্তবর্ষ ব্যাপি যুদ্ধ (১৭৫৬-৬৩ খ্রিস্টাব্দ) বাঁধে। এই যুদ্ধে হেরে যাওয়ার ফ্রান্সের উপনিবেশিক সাম্রাজ্য বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেন্ট ললেন্স এবং মিসিসিপি এই দুই অঞ্চল ফ্রান্সের হাত থেকে চলে যায়। পরবর্তীকালে নেপোলিয়নের যুদ্ধে (১৮০৩-১৫ খ্রিস্টাব্দ) কারণে আরো কিছু অধিকৃত্ত অঞ্চল ফ্রান্সের হাতছাড়া হয়। পশ্চিম দ্বীপপুঞ্জের কয়েকটি দ্বীপ, দক্ষিণ আফ্রিকার কয়েকটি অঞ্চল এবং ভারতের কয়েকটি অঞ্চল ছাড়া ফ্রান্সের অধীনে তেমন কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। পরবর্তীকালে তৃতীয় নেপোলিয়নের আমলে নতুনভাবে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের উত্থান ঘটে। ফ্রান্স দূরপ্রাচ্য এবং আফ্রিকা নতুন নতুন অঞ্চল দখল করতে শুরু করে। আফ্রিকার আলজিয়াস ও টিউনস অঞ্চল, পশ্চিম উপকূল এবং সেনেগল ফরাসি সাম্রাজ্য ভুক্ত হন। আন্নাম, কম্বওজ, টংকিং প্রভৃতি অঞ্চলের ওপর ফরাসি আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রশান্ত মহাসাগরের নিউ ক্যালিডোনিয়া অঞ্চলটিও ফ্রান্স অধিকার করে নেয়।
৩. ওলন্দাজের উপনিবেশ
হল্যান্ডের অধিবাসী ওলন্দাজগণ অনেক আগে থেকেই উপনিবেশে বিস্তারে নেমেছিল। জাভা, সুমাত্রা, বোর্নিয়ো এবং বালি দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে গঠিত ইন্দোনেশিয়া ইস্ট ইন্ডিয়া তে ওলন্দাজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। আফ্রিকায় লিমপোপো নদী পর্যন্ত সুবিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে ওলন্দাজের উপনিবেশ গড়ে ওঠে। ওলন্দাজের আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ (কেপ কলোনি ও কেপ অব গুড হোপ) দখল করেছিলেন। পরে ওলন্দাজরা কেপ কলোনি ইংরেজদের বিক্রি করে দেন। আফ্রিকায় প্রথম দিকে ওলন্দাজ শক্তির উপনিবেশ গুলি ছিল-নাটাল, অরেঞ্জ নদী উপত্যকা অঞ্চল এবং ট্রান্সভাল ইত্যাদি। ওলন্দাজ বণিক শক্তি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সিংহল বা শ্রীলঙ্কায় নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। পরে অবশ্য সেখানে ইংরেজদের অনুপ্রবেশ ঘটলে ওলন্দাজরা সিংহল ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়।
৪. পোর্তুগিজদের উপনিবেশ
ব্রিটিশ, ওলন্দাজ, ফরাসিদের মতো পর্তুগিজরা ও নৌশক্তিতে বলিয়ান ছিল। এশিয়ার মধ্যে ভারত ও চীনের বাণিজ্যিক লক্ষ্য নিয়ে পর্তুগিজরা ও প্রবেশ করেছিল। তারা ম্যাকাও বন্দর দিয়ে প্রবেশ করে এবং সেখানে বাণিজ্যিক অধিকার লাভ করে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া মালয়ে পর্তুগিজরা প্রথম উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল। আফ্রিকার গিয়ানা উপকূল, সফালা এবং অ্যাঙ্গালোতে উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল। এছাড়াও পত্রিকা আফ্রিকার পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলের মধ্যে এক যোগসূত্র গড়ে তোলারও প্রচেষ্টা করে।
৫. মার্কিনদের উপনিবেশ
উপনিবেশ দখলের প্রতিযোগিতা ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে আমেরিকাও যোগ দিয়েছিলে। মার্কিনরােশিয়া চীন এবং জাপানের সাম্রাজ্যবাদ কায়েমের উদ্যোগ নেন। চিন আফরিন যুদ্ধের পর মার্কিন রা অনুপ্রবেশ করে। উদীয়মান সূর্যের দেশ জাপানের সর্বপ্রথম মার্কিন সেনাপতি কমোডোর ম্যাথু পেরি পদার্পণ করেন (১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দ)। এছাড়াও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ফিলিপিনস দ্বীপপুঞ্জ এবং হাওয়ায় দ্বীপপুঞ্জ মার্কিনরাও নিজেদের সাম্রাজ্যভুক্ত করে।
৬. রুশনের উপনিবেশ
ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে একমাত্র রাশিয়া এশিয়া ভূখণ্ডের সঙ্গে সমুদ্রপথ ধরে যোগাযোগ গড়ে তুলতে চেয়েছিল। এশিয়া এবং আফ্রিকার বেস্ট কয়েকটি অঞ্চলের রুশ অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছিল। চিনে বিদেশিদের অনুপ্রবেশ শুরু হলে সেই যুগের রাশিয়া ও চীনের প্রবেশ করে। উনি শতকের মধ্যপ্রাচ্যের পারস্য দখলকে কেন্দ্র করে ইঙ্গ রুশো দ্বন্দ্ব বাধে। মধ্যে এশিয়ার মার্ভ, পাঞ্জু দেহ দখল করে এবং হীরার অভিযান চালিয়ে রাশিয়ার মধ্যে এশিয়া নিজের বিস্তার নীতি আবহতো রাখে। প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে রাশিয়া ভ্লাডিভস্টক নামে এক নৌ বন্দর প্রতিষ্ঠা করে।