তেলেনাপােতা আবিষ্কার গল্পে কোন্ পরিপ্রেক্ষিতে গল্পকথক যামিনীকে বিয়ে করার ব্যাপারে তার মাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন?
প্রেমেন্দ্র মিত্রের তেলেনাপােতা আবিষ্কার গল্পে মণিবাবুর সঙ্গে একটি ছােটো, অন্ধকার ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গল্পকথক দেখতে পান যে, একটি ভাঙা তক্তপােশে ছেঁড়া কাঁথা জড়ানাে কঙ্কালসার চেহারার যামিনীর মা শুয়ে রয়েছেন। চৌকির একপাশে পাথরের প্রতিমার মতাে দাঁড়িয়ে রয়েছে। যামিনী। দুই বন্ধুর পায়ের আওয়াজ শুনে বৃদ্ধা মনে করেন যে, যামিনী যার বাগদত্তা, সেই নিরঞ্জন এসেছে বুঝি। এরপর উৎফুল্ল হয়ে নিরঞ্জনকে উদ্দেশ করে বেশ কিছু আবেগময় কথা বৃদ্ধা বলে চলেন এবং নিরঞ্জন আগেরবারের মতাে পালিয়ে যাবে কি না তাও জিজ্ঞাসা করেন। ঘরে উপস্থিত বন্ধু মণি ও যামিনীকে স্তম্ভিত ও বিহ্বল করে দিয়ে এরপর গল্পকথক নিরঞ্জনের ভূমিকায় নিজেকে রেখে যামিনীর অসহায়, অন্ধ, বৃদ্ধা মাকে যামিনীকে বিবাহ করার ব্যাপারে আশ্বাস দেন। এ কথায় নিশ্চিন্ত হয়ে যামিনীর মা গল্পকথককে নিরঞ্জন ভেবে আরও অনেক কথা বলে হাঁপাতে থাকলে কথক যামিনীর দিকে তাকান। এই ঘটনার পর বৃদ্ধা কথককে জানান যে, যামিনীকে নিয়ে তিনি সুখী হবেন এবং প্রসঙ্গত যামিনীর অনেক প্রশংসাও করেন। বৃদ্ধার সেই আকুতিভরা কথাগুলি শুনে কথক কোনােদিকে তাকাতে পারেন না, পাছে চোখের জল তিনি গােপন করতে ব্যর্থ হন। তাই বৃদ্ধা এরপর যখন আবার তাকে জিজ্ঞাসা করেন যে, ‘যামিনীকে তুই নিবি ত বাবা’, তখন গল্পকথক স্পষ্টভাবেই তাঁকে কথা দেন যে, ‘আমি তােমায় কথা দিচ্ছি মাসিমা। আমার কথার নড়চড় হবে না।’
“আপনাকে কৌতুহলী হয়ে যামিনীর পরিচয় জিজ্ঞাসা করতেই হবে” -প্রসঙ্গ উল্লেখ করে উদ্দিষ্ট ব্যক্তির এমনটা করার কারণ লেখাে
প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্রের তেলেনাপােতা আবিষ্কার গল্পের গল্পকথক তেলেনাপােতার পানাপুকুরে বড়শি ফেলে দীর্ঘক্ষণ বসে থেকেও মাছ ধরতে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে ফিরে আসেন তাঁদের আস্তানায়। সেখানে ফিরে গিয়ে তিনি দেখেন যে, তাঁর মাছ ধরার ব্যর্থতার কথা ইতিমধ্যেই রাষ্ট্র হয়ে গেছে। বন্ধুরা ইতিমধ্যেই জেনে গেছে যে, পুকুরে ছিপ ফেলে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার পর ডুবে যাওয়া ফাতনা ভেসে ওঠার পর বড়শিতে মাছ তাে নয়ই, এমনকি টোপও ছিল না। এই বিষয়টি নিয়ে কথকের ঘুমকাতুরে বন্ধুটি এবং মণি তার সঙ্গে রসিকতা করলে গল্পকথক ব্যথিত হয়ে তাদের জ্ঞাত তথ্যের সূত্রটি সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেন। তখন বন্ধু মণি তাকে জানান যে, আর কেউ নয়, স্বয়ং যামিনীই তার নিজের চোখে সব কিছু দেখে তাদেরকে বিষয়টি জানিয়ে গেছে।
গল্পকথকের কাছে তখন জলের মতাে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, পুকুরঘাটে যে মেয়েটি কলশিতে জল ভরতে গিয়েছিল এবং যে মেয়েটির সহজ-সরল-স্বাভাবিক আচরণ সেই সময় তাঁকে বিস্মিত ও অভিভূত করে দিয়েছিল—সেই মেয়েটিই যামিনী। সেই কথকের মৎস্য-শিকারের অক্ষমতার কথা কৌতুকের সঙ্গে তার বন্ধুদের কাছে প্রচার করেছে। এই কারণেই কথক যামিনীর বিস্তৃত পরিচয় জানার জন্য কৌতুহল প্রকাশ করেছিলেন।
“আপনাকে কৌতুহলী হয়ে যামিনীর পরিচয় জিজ্ঞাসা করতেই হবে” -যামিনী সম্পর্কে কোন কোন তথ্য গল্পকথক অবগত হয়েছিলেন?
প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘তেলেনাপােতা আবিষ্কার’ গল্পে কথক তাঁর বন্ধু মণির কাছ থেকে জানতে পারেন যে, যামিনীর বৃদ্ধা, অন্ধ, বিধবা মা তাঁর এক দূর সম্পর্কিত বােনপাে নিরঞ্জনের সঙ্গে যামিনীর বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক করে রেখেছিলেন তাদের ছেলেবেলাতেই। চার বছর আগে নিরঞ্জন এসে যামিনীর মাকে জানিয়ে গিয়েছিল যে, বিদেশের চাকরি থেকে ফিরে এসেই সে যামিনীকে বিয়ে করবে। যদিও, নিরঞ্জন বিদেশে যায়নি। বৃদ্ধা তাঁর মেয়ে যামিনীর সঙ্গে নিরঞ্জনের বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে অত্যন্ত নাছােড়বান্দা ছিলেন বলেই, নিরঞ্জন যামিনীর মাকে ফিরে আসার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সে ইতিমধ্যেই অন্যত্র বিয়ে করে দিব্যি ঘর-সংসার করছে। নিরঞ্জনের এই দাম্পত্য-সংবাদ যামিনী জানলেও সে তার মাকে জানায়নি। কারণ বৃদ্ধা হয় এই সত্য বিশ্বাস করবেন না, আর যদি সত্য-সত্যই বিশ্বাস করেন, তাহলে শ্বাস বন্ধ হয়ে তক্ষুনিই তার মৃত্যু হবে। মণির কাছে যামিনীর এই দুঃখময় অতীত জানার পর যামিনীর মায়ের ঘরে গিয়েও তিনি যামিনী সম্বন্ধে অনেক কিছু শােনেন। যামিনীর মায়ের কাছ থেকে গল্পকথক জানতে পারেন যে, যামিনীর মতাে মেয়ে হয় না। দুঃখ কষ্ট বা যন্ত্রণায় বৃদ্ধা তার মেয়েকে নিরন্তর গঞ্জনা দিয়ে চললেও, যামিনী কখনও মুখে রা কাটে না। তেলেনাপােতার মতাে শ্মশানপুরীতে যামিনী একাধারে নারী ও পুরুষ হয়ে সংসারের সমস্ত ঝক্কি-ঝামেলা সামলায় যামিনী সম্বন্ধে এসব তথ্যই অবগত হয়েছিলেন গল্পকথক।
“আপনাদের পদশব্দ শুনে সেই কঙ্কালের মধ্যেও যেন চাঞ্চল্য দেখা দেবে” -সেই কঙ্কালের মধ্যেও চাঞ্চল্য দেখা দেওয়ার কারণ প্রসঙ্গ-সহ লেখাে।
প্রেমেন্দ্র মিত্রের তেলেনাপােতা আবিষ্কার গল্প থেকে সংকলিত এই উদ্ধৃতিটিতে কঙ্কাল বলতে যামিনীর অন্ধ, বিধবা, বৃদ্ধা, কঙ্কালসার চেহারার মায়ের কথা বলা হয়েছে। যামিনীদের জীর্ণ বাড়ির দোতলার একটি ঘরে তিনি থাকেন। কল্পকথক এবং তার বন্ধু মণি অন্ধকার, অপ্রশস্ত, ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে ওপরের সেই নির্দিষ্ট ঘরটিতে যখন পৌছােন, তখন একটিমাত্র জানলাবিশিষ্ট সেই ঘরটি দেখে গল্পকথকের মনে হয়েছিল যে, তা যেন মাটির তলার সুড়ঙ্গ-পথের কোনাে জায়গা। বাইরের অপেক্ষাকৃত আলােকিত পরিবেশ থেকে সেই প্রায়ান্ধকার ঘরে ঢুকে ঘরের ভেতরকার সব কিছু প্রথমে তাদের কাছে অস্পষ্ট মনে হয়েছিল। আস্তে আস্তে অন্ধকারে চোখ সয়ে এলে তাঁরা দেখতে পান, ঘর জুড়ে থাকা একটি ভাঙা তত্ত্াপােশে ছেঁড়া কাথায় জড়ানাে একটি কঙ্কালসার মূর্তি শায়িত অবস্থায় রয়েছে এবং চৌকির একপাশে যামিনী পাথরের প্রতিমার মতাে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বন্ধু-সহ কথকের পদশব্দ শুনে যামিনীর মা ভেবেছিলেন যে, যামিনী যার বাগদত্তা, সেই নিরঞ্জন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসছে। নিরঞ্জনের ফিরে আসার ভাবনায় বৃদ্ধা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলেন বলেই, মণিবাবুদের আগমনে তার কঙ্কালসার দেহের মধ্যে চাঞ্চল্য লক্ষ করা গিয়েছিল।