ভূমিকা
১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ২৪ আগস্ট ভারত সরকার ঘোষণা করে যে, আজাদ হিন্দ বাহিনীর বন্দী সেনাদের রাজ্য বিদ্রোহের অপরাধে দিল্লির লালকেল্লার প্রকাশ্যে কোর্ট মার্শাল শুরু হবে। এই মেয়ে ছেলের প্রতিবাদে সারা ভারতে প্রবল উন্মাদনা দেখা দেয়। এই বিচারের প্রতিবাদে যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় তাদের ব্রিটিশ সরকার নিজেদেরই মৃত্যু ঘটাবনে শুনতে পায়।
আজাদ হিন্দ সেনাদের বিচারে কেন্দ্র করে সংঘটিত গণ অভ্যুত্থান
১. দেশব্যাপী প্রতিবাদ
সরকারি ঘোষণা আরো আগে বন্দি আজাদ হীন সেনাদের ভারতে পাঠানোর পরই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিবাদ শুরু হয়। ১৬ আগস্ট শ্রীনগরে এক জনসভায় জহরলাল আজাদহীন সেনাদের দেশপ্রেমিক বলে আখ্যায়িত করেন এবং সরকারকে তাদের ওপর ক্ষমতাশীল হতে বলেন। এত কিছু সত্বেও সরকারি ভাবে যখন তাদের বিচারের কথা ঘোষণা করা হয়, তখন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলগুলিও প্রতিবাদে সোচ্চার হয়। সেপ্টেম্বর মাসে বোম্বাইয়ে কংগ্রেসের যুদ্ধ পরবর্তী প্রথম অধিবেশনে বন্দী সেনাপতিদের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
২. বিচার শুরু
৫ নভেম্বর ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ দিল্লীর লালকেল্লায় আজাদ এর বিচার শুরু হয়। কুড়ি হাজার বন্ধু আজাদ হিন্দ সেনাদের মধ্যে প্রকাশ্যে মাত্র কয়েকশো জনের বিচারে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যে তিনি সেনাপতি প্রথম বিচারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তাদের একজন মুসলমান, একজন হিন্দু ও অন্যজন শিখ। এভাবে বেছে বেছে তিন ধর্মের তিনজন মানুষের বিচারের প্রহসনে হিন্দু-মুসলমান-শিখ নির্বিশেষে গোটা ভারতবর্ষে গর্জে ওঠে।
৩. আজাদ হিন্দু সেনাদের সমর্থনে সর্বস্তরের মানুষ
এই বিচারকে কেন্দ্র করে সারা দেশের প্রতিবাদে ঝড় ওঠে। পোস্টার-পত্রপত্রিকা-পুস্তিকা, সভা সমিতি তাদের মধ্যে দিয়ে খেটে খাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে বিত্তশালীন ভারতীয় পর্যন্ত ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিবাদে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসে। জাতি ধর্ম বর্ণ, অনুষ্ঠান ও রাজনৈতিক মতপার্থক্য নির্বিশেষে সারা ভারতের মানুষই এই আন্দোলনে শামিল হয়।
(১) কংগ্রেসের আইনজীবীদের সমর্থন : আজাধীন সেনাদের পক্ষে আইনগজ্ঞ হিসেবে এগিয়ে আসেন ভুল-ভালি দেশাই, জহরলাল নেহেরু, অরুনা আসফ আলী, তেজবাহাদুর সপ্রউ, কৈলাসনাথ কাটজু শ্রমিকের মতে কংগ্রেসের প্রথম সারির আইন বিশেষজ্ঞ। জহরলাল নেহেরু দীর্ঘ ২৫ বছর পর নিজের গায়ে তুলে নেন আইনজীবীর পোশাক।
(২) ভারতীয় সেনাদের সমর্থন : শুধু সাধারণ মানুষই নয়, বিদেশে সামরিক উদ্দীপারা ভারতীয় সেনারা পর্যন্ত সামরিক শৃঙ্খলা কে লংঘন করে আজাদিন বন্দিদের সমর্থনে ডাকা সভায় দলে দলে যোগ দিতে শুরু করে। কলকাতা, এলাহাবাদ, কানপুরের বিমান বাহিনীর কর্মীচারী রাজা-াধীন সেনা সমর্থনে অর্থ সংগ্রহেও নামে। কেবল পদাতিক নয়, সেনাবাহিনীর তিনটি শাখাতেই এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
৪. বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কার্যকলাপ
কংগ্রেসের পাশাপাশি মুসলিম লীগ, হিন্দু মহাসভা, অকালি দল, শিখ লিগ, কমিউনিস্ট পার্টি, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ, ইউনিয়নিস্ট পার্টি, জাস্টিস পার্টি প্রভৃতি সমস্ত রাজনৈতিক দলের মত পার্থক্য ভুলে আজাদ হিন্দ সেনাদের মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। এ ব্যাপারে ভাইসরয় ওয়াভেল লিখেছেন -সমস্ত রাজনৈতিক দল একই পদ্ধতি অনুসরণ করেছে। তবে সবার চেয়ে বেশি সোচ্চার কংগ্রেস। দেশের বিভিন্ন পৌরসভা, জেলা বোর্ড, প্রবাসী ভারতীয়, বিভিন্ন গুরুদ্বার কমিটি, বোম্বাই ও কলকাতার চিত্র তারকারা এমনকি বোম্বাই ও অমরাবতীর টাঙ্গাওয়ালারা ও অর্থ সাহায্য করে।
৫. গণবিক্ষোভ
জাতি ধর্ম বর্ণ, সামাজিক অবস্থান ও রাজনৈতিক মত পার্থক্য নির্বিশেষে অসামুদ্রিক হিমাচল ভারতবর্ষে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সামিল হয়।। আজাধীন সেনাদের বিচারের সাহায্যে জন্য দেশের নানা স্থান থেকে আর্থিক সাহায্য আসতে থাকে। দেশ জুড়ে পালিত হয় আজাদ হিন্দ দিবস ও আজাদ হীন সপ্তাহ। জয় হিন্দ আজাদ হিন্দ সেনাদের মুক্তি চাই, লালকেল্লা ভেঙ্গে ফেলো, ইত্যাদি নানা ধবনীতে ভারতের মুখরিত হয়ে ওঠে। ছোট বড় অসংখ্য মিছিল সভা সমিতি দেশ জুড়ে সংঘটিত হতে থাকে। সবচেয়ে বড় সভাতে আয়োজিত হয় দক্ষিণ কলকাতায় দেশপ্রিয় পার্কে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বরে। কয়েক লক্ষ মানুষের ওই সমাবেশে ভাষণ দেন নেতাজি-অগ্রজ শরৎচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহেরু ও বল্লভ ভাই প্যাটেল।
৬. লিখিত প্রতিবাদ
বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লিখিতভাবে এমনকি পোস্টারের মাধ্যমে আজাদ হিন্দ সেনাদের বিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হয়। বিশ্বাসঘাতক নয়, দেশপ্রেমিক নামে পুস্তিক আয় আজাদ হিন্দ সেনাদের দেশপ্রেম ও বীরত্বের কাহিনী প্রকাশিত হয়। দিল্লি, কলকাতা এবং লাহোরে পোস্টারে লেখা হয়, “বিচারে আজাদ হীন সেনাদের মৃত্যু দেওয়া হলে কুড়িটি ইংরেজ কুত্তাকে হত্যা করা হবে।”
৭. কলকাতায় ছাত্র আন্দোলন
(১) প্রসার : কলকাতার আন্দোলন ছিল দেশের মধ্যে সবচেয়ে প্রবল। এখানে আন্দোলনের ছাত্ররা খুবই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল। ২১ নভেম্বর ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে প্রাদেশিক ছাত্র কংগ্রেস, ছাত্র ব্লগ ফরওয়ার্ড ব্লক এর ছাত্র সংগঠন, এবং ফেডারেশন কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন এবং ইসলামিয়া কলেজে বর্তমানে মৌলানা আজাদ কলেজ সহ নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা মিছিল বের করে। তারা ডালহৌসি স্কোয়ারে ঢুকতে গেলে পুলিশ গুলি চালায়। এতে ক্যালকাটা টেকনিক্যাল স্কুলের ছাত্র রামেশ্বর ব্যানার্জি এবং শ্রমিক আবদুস সালমান মারা যান। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরে দুদিন কলকাতা দূরে চলে প্রচন্ড বিক্ষোভ। ট্রাম, বাস, ট্রেন, ট্যাক্সি, রিক্সা সহ বাজার হাট, স্কুল কলেজ, কলকারখানা সবকিছু বন্ধ থাকে।
(২) সরকারি দমন নীতি : কলকাতার সর্বত্র ধর্মঘট, অবরোধ, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি ঘটনা ঘটতে থাকে বিক্ষোভ চলাকালে পুলিশ গুলিতে দুজন ছাত্রের মৃত্যু হলে সমগ্র কলকাতার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। জনরোষে প্রশাসন অচল হয়ে পড়লে পুলিশের গুলি চলে। দাঙ্গা হাঙ্গামা ৩৩ জন নিহত এবং ৪০০ জন পুলিশ, সরকারি কর্মী ও সাধারণ মানুষ আহত হয়। বহু সরকারি গাড়ি ভাঙচুর হয়। এই গণবিক্ষোভ প্রসঙ্গে ছোটলাট কেসি ভাইসরয় ওয়াভলকে এক পত্রে লেখেন -“জনতার উপর গুলি চালালে তারা দাঁড়িয়ে থাকছে। বড়জোর একটু পিছিয়ে গিয়ে আবার আক্রমণ করছে।
৮ রশিদ আলী দিবস
১ ডিসেম্বর ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে সরকার ঘোষণা করে যে, হত্যা ও নিশংস ব্যবহারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ছাড়া সব বন্দিকেই মুক্তি দেয়া হবে। কিন্তু পরের বছর ১১ থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি কলকাতা আবার বিক্ষোভে উত্তাল হলে ওঠে আজাদ হিন্দ ফৌজের ক্যাপ্টেন রশিদ আলী বিচারকে কেন্দ্র করে। আজাদ হিন্দ বাহিনীর ক্যাপ্টেন রশিদ আলীকে বিচারে সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে এগারোই ফেব্রুয়ারি কলকাতায় ব্যাপক ছাত্র ধর্মঘট, ১২ তারিখে রশিদ আলী দিবস পালিত হয় এবং সাধারণ ধর্মঘট কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী শিল্পাঞ্চলে অচল করে দেয়।
ওইদিন সন্ধ্যায় ওয়েলিংটন স্কোয়ারের এক বিশাল সমাবেশ লিগ, কংগ্রেস, কমিউনিস্ট নেতার বক্তব্য রাখার পর ডাল ও শেষ স্কয়ারের দিকে মিছিল এগিয়ে চলে কলকাতায় অসামরিক প্রশাসন-ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। ওই কদিনের সংঘর্ষে সরকারি হিসেবে ৮৪ জন নিহত ও ৩০০ জন আহত হয়।। কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য কলকাতা এই গণ-আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সেদিন লিখেছেন, “বিদ্রোহ আজ, বিদ্রোহ চারিদিকে, আমি যাই তারই দিন পঞ্জিকা লিখে।”
৯. গুরুত্ব
(১) সাম্প্রদায়িক ঐক্য : জাতি ধর্ম নির্বিশেষে আপার মোর ভারতবাসী নিজেদের সামাজিক অবস্থান ও রাজনৈতিক মত পার্থক্য ভুলে আজাদ হীন সেনাদের মুক্তি দাবিতে সোচ্চার হয়।
(২) ছাত্র ও শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনে : আজাদ হিন্দ ফৌজের বিয়ের সেনানিদের অন্যায়ের বিচারের বিরুদ্ধে ছাত্র, শ্রমিক সহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ রুখে দাঁড়ায়। ছাত্র প্রতিবাদ হিসেবে সরকারি স্কুল-কলেজ ত্যাগ করে, কৃষক ও শ্রমিকরা বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ মিছিল ও ধর্মঘট পালন করে। জহরলাল নেহেরু বলেন -“এই বিচার স্বাধীনতার লক্ষ্যে যাত্রা পথে আমাদের অনেক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে। ভারতের ইতিহাসে আর কখনো ও এত বিচিত্র জনগোষ্ঠীর এমন ঐক্যবদ্ধ আবেগ অনুভূতির প্রকাশ দেখা যায়নি।” ইস্টার্ন কম্যান্ডের জি.ও.সি. স্যার ফ্রান্সিস ফৌজের ব্যাপারটি “ভারতীয় সেনাবাহিনী সৌধকে টলমল করে দেয়।”
উপসংহার
এ আন্দোলনের তীব্রতা ও ব্যাপকতায় বিস্মিত ব্রিটিশ সরকার শেষ পর্যন্ত আজাদহীন সেনাদের বিচার বাতিল করতে বাধ্য হয়। অমলেশ ত্রিপাঠী বলেছেন -“মৃত (?) সুভাষ, জীবিত সুভাষের চেয়ে ঢের বেশি শক্তিশালী প্রতিপন্ন হয়েছিল।”