আইন যেখানে ন্যায়ের শাসক,/সত্য বলিলে বন্দী হই | বাণীর মুক্ত শতদল যথা আখ্যা লভিল বিদ্রোহী | দ্বীপান্তরের ঘানিতে লেগেছে যুগান্তরের ঘূর্ণিপাক | ধ্বংস হল কি রক্ষ-পুর

“আইন যেখানে ন্যায়ের শাসক,/সত্য বলিলে বন্দী হই”- অংশটির মধ্য দিয়ে কবির কোন মনােভাব প্রতিফলিত হয়েছে?

কাজি নজরুল ইসলাম রচিত ‘ফণি-মনসা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘দ্বীপান্তরের বন্দিনী কবিতায় কবি লক্ষ করেছিলেন স্বাধীনতা-প্রিয় কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের নারকীয় অত্যাচার। আইনের দ্বারা সেখানে ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হলেও মানুষের সত্য ভাষণের অধিকারকে ঘুরপথে কেড়ে নেওয়াই হয়েছিল। সত্য ভাষণের পরিণতি সেখানে শাস্তি। আইন কার্যত পরিণত হয় এক ধরনের তামাশায়। তা কেবল ব্যবহার করা হয় শােষণ ও অত্যাচারের পক্ষে রায় দানের জন্য, ভারতবাসীর স্বাধীনতাকামী আন্দোলনকে ভোতা করে দেওয়ার জন্য এবং দ্বীপান্তরে নির্বাসনে পাঠিয়ে প্রতিবাদী কণ্ঠকে নীরব করে দেওয়ার ক্ষেত্রে। এই নীতিহীন অত্যাচারী শাসনব্যবস্থা প্রসঙ্গেই কবি প্রশ্নোক্ত মন্তব্যটি করেছেন।

নজরুলের কবিচেতনার মূল নিহিত ছিল স্বাধীনতার স্বপ্নে আর সাম্রাজ্যবাদী এবং সামাজিক শােষণের বিরুদ্ধে। আন্দামানে স্বাধীনতাকামী মানুষদের নির্বাসন এবং অত্যাচারের নির্মমতাকে কবি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। অত্যাচারের অবসানে স্বাধীনতার স্বপ্ন তাই তাকে পুনর্বার আন্দোলিত করেছে। যুগান্তরের ধর্মরাজ’-এর আবির্ভাব কবি যেন মর্মচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন। আর তাকে আবাহনের জন্যই আকুল হয়ে উঠেছেন কবি। যে দ্বীপান্তর স্বাধীনতার স্বপ্নকেও নির্বাসিত করেছিল, সেখানেই ‘যুগান্তরের ঘুর্ণিপাক’-এর অর্থাৎ দিনবদলের সম্ভাবনা দেখেছেন কবি।

“বাণীর মুক্ত শতদল যথা আখ্যা লভিল বিদ্রোহী”- এই মন্তব্যটির মাধ্যমে বক্তা কী বােঝাতে চেয়েছেন?

কবি কাজি নজরুল ইসলাম তার দ্বীপান্তরের বন্দিনী কবিতায় সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ শাসনের অত্যাচারী স্বরূপকে তুলে ধরেছেন। অস্ত্রের সাহায্যে ভারতবাসীর স্বাধীনতার দাবিকে সেখানে দমিয়ে রাখা হত। স্বাধীনতার কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে অসংখ্য বিপ্লবী প্রাণকে শাস্তিস্বরূপ দ্বীপান্তরে নির্বাসন দেওয়া হত।

দ্বীপান্তরের কারাগারে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে চিরতরে নীরব করে স্বদেশবাসীর মনে ভীতির সঞ্চার করা এবং তাদের দেশপ্রেমের উদ্দীপনাকে নষ্ট করে দেওয়া ছিল ইংরেজদের উদ্দেশ্য। স্বাধীনতার শ্বেতপদ্ম এভাবেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের অস্ত্রের আঘাতে। সেই সময় আইন পরিণত হয় এক ধরনের প্রহসন বা তামাশায়। আইনের নাম করে ন্যায়কে দমিয়ে রাখা হত। সত্যবাদীকে সভ্যভাষণের অপরাধে বন্দি রাখা হত যাতে আর কেউ সত্য কথা বলে অপরকে উজ্জীবিত করার সাহস না পায়। এই পরিস্থিতিতে যে বা যারা স্বাধীনতা এবং মুক্তির কথা বলে, তাদেরই বিদ্রোহী আখ্যা দেওয়া হয়। ঔপনিবেশিক শাসনের নির্লজ্জ অত্যাচারী চরিত্রকে এইভাবে প্রশ্নোধ্ধৃত অংশে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন।

যারা দেশমাতৃকার বন্দনা করতে চান, তাদের সকলকেই সেই বন্দিত্বের কাহিনি থেকে প্রেরণা নিতে হবে, তাতে শ্রদ্ধা রাখতে হবে। দেশের জন্য ত্যাগ ও তিতিক্ষার আদর্শ কবির মতে আন্দামানে কারাগারের আড়ালেই বন্দি হয়ে আছে। সেই আদর্শকে স্বীকার করা সকল দেশসেবকেরই যে কর্তব্য।

“দ্বীপান্তরের ঘানিতে লেগেছে যুগান্তরের ঘূর্ণিপাক” -‘যুগান্তরের ঘূর্ণিপাক’ কথাটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করাে।

কৃষ্ণের শঙ্খের নাম পাঞ্চজন্য। নজরুল ইসলাম তাঁর দ্বীপান্তরের বন্দিনী কবিতায় স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ মানুষদের এই পাঞ্জন্য শাঁখ বাজাতে বলেছেন। এই শাঁখের শব্দেই থাকবে যুগান্তরকে স্বাগত জানানাের আহ্বান। দীর্ঘ অত্যাচার অবিচারের অবসানে নতুন যুগকে স্বাগত জানানাের জন্যই কবি পাঞ্চজন্য শাঁখ বাজাতে চেয়েছেন। পঞজন নামক রাক্ষসকে হত্যা করার পর তার অস্থি দিয়ে তৈরি হয় পাঞ্চজন্য শাঁখ। সেই দৃষ্টান্তকে স্মরণে রেখেই ব্রিটিশদের অত্যাচারী শাসনব্যবস্থা ‘রক্ষ-পুর’-কে ধ্বংস করার জন্যই কবি অত্যন্ত সুকৌশলে পাঞ্জন্য শঙ্খের প্রসঙ্গ এই কবিতায় উল্লেখ করেছেন।

সেই সময়ে দেশপ্রেমিক স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আন্দোলনকে স্তন্ধ করে দেওয়ার জন্য, তাদেরকে স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীনতার লড়াইকে ভোঁতা করে দেওয়ার জন্য নির্বাসনে পাঠিয়ে দেওয়া হত আন্দামানে। কিন্তু এরই মধ্যে কবি লক্ষ করেন ইতিহাসের অনিবার্যতাকে। তার কানে ভেসে ওঠে ‘মুক্ত বদ্ধ সুর, অর্থাৎ স্বাধীনতার কণ্ঠস্বর। যুগান্তরের ঘূর্ণিপাক’ শব্দবন্ধে এই দিকেই কবি ইঙ্গিত করেছেন। ঘূর্ণিপাককে কেউ যেমন ঠেকিয়ে রাখতে পারে না, তেমনি দ্বীপান্তর আন্দামানের ঘানিতে লাগা ঘূর্ণিপাকের প্রবলতাকেও কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না বলে কবির বিশ্বাস। ফলে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে ভারতবর্ষ দ্রুত স্বাধীনতা লাভ করবে বলেই কবির নিশ্চিত প্রত্যয়।

“ধ্বংস হল কি রক্ষ-পুর”— ‘রক্ষ-পুর’ কী এবং কীভাবে তা ধ্বংস করা সম্ভব?

স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা কাজি নজরুল ইসলামের ‘ফণি-মনসা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘দ্বীপান্তরের বন্দিনী কবিতায় রক্ষ-পুর’ বলতে কবি অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।

রামায়ণ কাহিনি অনুসারে, সীতাকে রাক্ষসরাজ রাবণ হরণ করে নিয়ে গিয়ে লঙ্কার পঞ্চবটী বনে লুকিয়ে রেখেছিলেন। পরাধীন ভারতের বিপ্লবীদের ব্রিটিশরা আন্দামানে দ্বীপান্তরে বন্দি করে রাখত। এ ছাড়াও, এ দেশে নানাভাবে চলত ব্রিটিশদের কঠোর দমন-পীড়ন। এইভাবে তারা ভারতমাতাকে শিকলের বাঁধনে বন্দি করে রেখেছিল। কিন্তু কবি নিশ্চিত জানেন, আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের এই নিঃশ্বার্থ আত্মত্যাগ কিছুতেই সম্পূর্ণ ব্যর্থ হওয়ার নয়। ইতিহাসের অনিবার্যতার সূত্র ধরে এরপর কবি স্থির বিশ্বাসে বলে ওঠেন যে, পাপ-পুণ্যের বিচারকর্তা যুগান্তরের ধর্মরাজের চরণ-পদ্ম বর্তমানে কেবল ‘পদ্মের ওপর রাখার অপেক্ষা। তাই যে-দ্বীপান্তর স্বাধীনতার স্বপ্নকে নির্বাসিত করেছিল, সেইখানেই কবি লক্ষ করেছেন যুগান্তরের ঘূর্ণিপাক’ এর সম্ভাবনা। যার প্রবলতাকে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না, নিশ্চিতরূপে যা ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে ভারতবর্ষকে স্বাধীন করতে সক্ষম হবেই বলে কবির বিশ্বাস। কবিতাটির উপসংহারে কবি তাই বিপ্লবী প্রাণের আবাহনের জন্য দেশবাসীকে পাঞ্চজন্য শাঁখ’ বাজাতে বলেছেন।

বাংলা সব প্রশ্ন উত্তর (একাদশ শ্রেণি)

Leave a Comment