অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি প্রবর্তনের উদ্দেশ্য গুলি কি ছিল? এই নীতির বিভিন্ন শর্ত গুলি উল্লেখ করো? অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির প্রয়োগ উল্লেখ করো?

সূচনা

ভারতের সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ গঠন জেনারেল লর্ড ওয়েলসলি ১৭৯৮-১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে তার শাসনকালের দেশের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটানো ও সাম্রাজ্যের ভিত্তি সুদৃঢ় করার করার উদ্দেশ্যে ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দে এক আধিপত্যকারী নীতি প্রবর্তন করে এবং বহু দেশীয় রাজ্যকে এই নীতি গ্রহণের বাধ্য করেন। অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি বা বশ্যতামূলক মিত্রতা নীতি নামে পরিচিত।

অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি প্রবর্তনের উদ্দেশ্য

সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসনের লর্ড ওয়েলেসলি ভারতে এসে দেশের সুশাসন প্রবর্তন, ভারত থেকে ইংল্যান্ডের শিল্প কারখানা গুলির জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহ, ভারত থেকে ফরাসি প্রভাব দূর করা প্রভৃতি বিষয়গুলিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে এদেশে অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি প্রবর্তন করেন। ওয়েল সলিড অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি প্রবর্তনের বিভিন্ন উদ্দেশ্য ছিল, যেমন-

১. সুশাসন প্রবর্তন

ইউরোপের সভ্যতা ও শাসন ব্যবস্থার শ্রেষ্ঠত্ব কে বিশ্বাসী লর্ড ওয়েলেসলি‌ মনে করতেন যে, ভারতীয় রাজ্যগুলি শাসন ব্যবস্থা নীতিহীন অত্যাচারের নামান্ত আর মাত্র। ভারতীয়দের সুশাসনের জন্য ওয়েল স্টোরি এদেশে ব্রিটিশ শাসনে ব্যাপক প্রসার ঘটানো উচিত বলে মনে করতেন।

২. ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব

১৭৮০ খ্রিস্টাব্দের পরে ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের ব্যাপক প্রসার ঘটলে সেখানকার কলকারখানার শিল্প উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। শিল্প উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল সংগ্রহ এবং উৎপাদিত পণ্য বিক্রির জন্য ভারতের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রসার অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে।

২. ফরাসি আধিপত্য রোধ

ভারতের ব্রিটিশদের নিকট্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ইউরোপের শক্তি ছিল ফরাসি। টিপু সুলতান, সিন্দিয়া প্রভৃতি রেশিও শাসকরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে থেকে ফরাসি শক্তির আধিপত্য দূর করার উদ্দেশ্যে এদেশের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ব্যাপক প্রসারে উদ্যোগ নেওয়া হয়।

অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির শর্তাবলী

অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির প্রসঙ্গে লর্ড ওয়েলসলি নিজেই বলেছেন যে, দেওয়ানী লাভের পর অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি ছিল সবচেয়ে পৃথক ও উপযোগী ব্যবস্থা। অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির বিভিন্ন শর্তে বলা হয়েছে –

১. ব্রিটিশ বাহিনী নিয়োগ

এই মিত্রতা চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশী ও রাজ্যগুলি তাদের রাজ্যের ব্রিটিশ রেসিডেন্ট বা প্রতিনিধি সহ একদল ব্রিটিশ সেনারা মোতায়েন করবেন।

২. সেনাদলের ব্যয়

দেশীয় রাজ্যগুলি নিজেদের রাজ্যে মোতা আইন করার ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ব্যয়ভার নির্বাহ করবেন অথবা ব্যয়ভার ভবনের পরিবর্তে রাজ্যের একাংশ ব্রিটিশ সরকার কে ছেড়ে দেবে।

৩. ব্রিটিশ রেসিডেন্ট নিয়োগ

চুক্তিতে আবদ্ধ দেশীয় রাজ্যগুলি রাজার দরবারে একজন ইংরেজ প্রতিনিধি বা রেসিডেন্ট থাকবে।

৪. রাজ্যের নিরাপত্তা

মিত্রতা চুক্তিতে আবদ্ধ দেশীয় রাজ্যগুলি নিরাপত্তার দায়িত্ব থাকবে ইংরেজ কোম্পানির হাতে। কোম্পানি মিত্র রাজ্যগুলিকে বৈদেশিক আক্রমণ ও অভ্যন্তরীণ সংকট থেকে রক্ষা করবে।

৫. বিদেশ নীতি

মিত্র দেশীয় রাজ্যগুলির বিদেশনীতি কোম্পানির নির্দেশের পরিচালিত হবে। পাঠান মিত্র দেশের রাজ্যগুলি ইংরেজ কোম্পানির অনুভূতি ছাড়া অন্য কোন শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বা কোন দেশীয় রাজ্যের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর বা মিত্রতায় আবদ্ধ হতে পারবে না।

৬. কর্মচারীর নিয়োগ

মিত্র দেশীয় রাজ্যগুলির ব্রিটিশ ছাড়া অন্য কোন ইউরোপকে তাদের রাজ্যের কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ করতে পারবেন না। ইতিপূর্বে নিয়োগ খাওয়া অব্রিটিশ ইউরোপের কর্মচারীদের বরখাস্ত করতে হবে।

৭. মিত্র রাজ্য গুলির বিরোধ

মিত্রতা চুক্তিতে আবদ্ধ দেশীয় রাজ্যগুলির মধ্যে কোন বিরোধ বাধলে ব্রিটিশ সরকারের মীমাংস সকল মিত্রকে মেনে নিতে হবে।

৮. কোম্পানির শক্তি

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কে ভারতের শ্রেষ্ঠ শক্তি হিসেবে সকল মিত্র রাজ্য মেনে নিতে বাধ্য করবে।

অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি প্রয়োগ

বিভিন্ন দেশের রাজ্যে অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এই রাজ্যগুলি হল –

১. হায়দ্রাবাদ

দেশীয় রাজাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা দুর্বল চিত্ত ও ভীরু হায়দ্রাবাদের নিজাম সর্বপ্রথম ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্য জানিয়ে অভিনেতা মূলক মিত্রতা চুক্তি স্বাক্ষর ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে করেন।

২. অন্যান্য রাজ্য

নিজামীর পর একে একে সুরাট ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে, তাঞ্জোন ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে, কর্ণাটক ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে, অযোধ্যা ১৮১ খ্রিস্টাব্দে প্রভৃতি দেশীয় রাজ্য অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।

৩. মহীসুরে বিরোধ

মহীশুরের টিপু সুলতানা অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তিগ্রহণে রাজি না হলে ইংরেজদের সঙ্গে তার সংঘর্ষন অনিবার্য হয়ে ওঠ। চতুর্থ ইঙ্গ মহীশূর যুদ্ধের টিপুর পতন ঘটে ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে।

৪. মারাঠাদের সঙ্গে বিরোধ

মারাঠা পেশোয়া দ্বিতীয় বাজীরাও ইংরেজদের সঙ্গে বেসিনের সন্ধি স্বাক্ষর করে ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে অধীনতামূলক চুক্তি মেনে নেন।

৫. রাজপুত রাজ্য সমূহের ভূমিকা

মালব, বুন্দেলখন্ড, উদয়পুর, যোধপুর, জয়পুর ও অন্যান্য বিভিন্ন ক্ষুদ্র রাজপুত রাজ্যগুলি ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তি গ্রহণ করে।

উপসংহার

১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকে এই নীতির মাধ্যমে কয়েক দশকের মধ্যে ভারতে অসংখ্য দেশ আধিপত্য সুখ প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশীয় রাজ্যগুলির অর্থ, সম্পদ ও আনুগত্য লাভ করে ব্রিটিশ সরকার ভারতের অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। অপরদিকে এই চুক্তিতে আবদ্ধ দেশীয় রাজ্যগুলির সব ধরনের স্বাধীনতা ও অধিকার হারিয়ে সম্পূর্ণরূপে ব্রিটিশদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment