অতীতে উত্তরাধিকার (Inheritance of the Past) ধারণা রেসিপি ও ইতিহাস চর্চা বা কল্পনা শক্তি (Indigenous imaginations)- র সম্বন্ধে বর্ণনা করো?

দেশীয় ইতিহাসচর্চা বা কল্পনাশক্তি

১. হিন্দু চেতনাসম্পন্ন

জেমস মিলসহ বেশ কিছু ঐতিহাসিক তাদের ইতিহাস চর্চার মধ্যে দিয়ে হিন্দু সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে আক্রমণ করেছিলেন। মিল উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে মুসলিম শাসন হিন্দুদের তুলনায় উৎকৃষ্টতর বলে আখ্যা দেন। তিনি হিন্দুদের মধ্যে সত্যবাদীতার অভাব রয়েছে বলে সমালোচনা করেন। হিন্দুদের ওপর এই আক্রমণ রোদের লক্ষ্যে বেশ কিছু মনীষী এগিয়ে আসেন। রাজনারায়ণ বসু, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হিন্দু ধর্ম ও হিন্দু ধর্ম হিন্দু ধর্ম শাস্ত্রের নতুন ব্যাখ্যা দিয়ে হিন্দু ধর্মকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেন। থিওসফিক্যাল সোসাইটি ও আর্য সমাজের প্রচেষ্টায় প্রাচীন হিন্দু ধর্মের হৃত মর্যাদা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী, বিনায়ক দামোদর শোভাকর ছাড়াও বেশ কিছু ঐতিহাসিক রাজপুত্র মুসলিম দ্বন্দ্বের উল্লেখ করে উগ্র হিন্দুত্ববাদী ইতিহাস লেখেন।

২. মুসলিম চেতনাসম্পন্ন

কর্নেল টবের ‘Annals and Antiquities of Rajasthan’ -কে তথ্যের উৎস হিসেবে ব্যবহার করে এক শ্রেণীর ঐতিহাসিক রাজপুত্র মুসলিম দ্বন্দ্বে, মুসলিমদের হেয় প্রতিপন্ন করেন। হিন্দুদের তরফে রাজপুত, মারাঠা ও শিখদের জাতীয় বীর হিসেবে তুলে ধরার প্রচেষ্টায় মুসলিমরা উদ্বিগ্ন হয়। তারাও তখন হিন্দু চেতনায় এই প্রতিক্রিয়া হিসেবে ইসলামের গৌরবময় ইতিহাস তুলে ধরার উদ্যোগ নেন। পাশাপাশি এক শ্রেণীর ঐতিহাসিক এ দেশের প্রাচীন হিন্দু শাসনের তুলনায় সুলতানি ও মোগল শাসনের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের উদ্যোগ নেন। স্যার সৈয়দ আহমেদের হাত ধরে যে মুসলিম চেতনার জাগরণ ঘটে তার‌ই বাহক ছেলের মৌলানা শওকৎ আলী, মোহাম্মদ আলী জিন্না প্রমুখ।

৩. আঞ্চলিক ইতিহাস

ঐতিহাসিক রোমিলা থাপ্পার বলেছেন ইতিহাস রচনা প্রণালীর এক মূল্যবান শাখা হলো আঞ্চলিক ও স্থানীয় ইতিহাস। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে নানা ঐতিহাসিক কাহিনী ও ঘটনা উঠে এসেছে আঞ্চলিক ইতিহাসগুলিতে।

(১) অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষার ইতিহাস : গোবিন্দ সখারাম সারদেশাই তিন খন্ডে ‘নিউ হিস্ট্রি অফ দা মারাঠাস’ নামে গ্রন্থটি লেখেন। মোহাম্মদ লতিফ রচনা করেন হিস্ট্রি অফ দা পাঞ্জাব যাতে ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত পাঞ্জাবের ইতিহাসে উল্লেখ মেলে। শ্যামল দাস হিন্দি ভাষায় পাঁচ খন্ডে লেখেন ‘বীরবিনোদ’ নামে মেবারের ইতিহাস, যা রাজপুতদের প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

রাজেন্দ্রলাল মিত্র দুই খন্ডে রচনা করেন ‘অ্যান্টিকুইটিজ অব ওড়িশা’, রামকৃষ্ণ গোপাল ভান্ডারকার লেখেন ‘আর্লি হিস্ট্রি অফ দা ডেকান’, যাতে তিনি প্রাচীনকাল থেকে মুসলমান বিজয় পর্যন্ত দাক্ষিণাত্যের ইতিহাস তুলে ধরেন। কে. ভি. কঋষ্ণআয়ার তার ‘হিস্ট্রি অফ কেরালা’ গন্ধে ঔপনিবেশিক পর্বের কেরালায় ইতিহাস তুলে ধরেন, নরেন্দ্রনাথ রায় তার ‘দ্য অ্যানালস অব। ধর্ম আর্লি ইংলিশ স্টেটমেন্ট ইন বিহার’ গ্রন্থে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি জন্ম লগ্ন থেকে ওয়ারেন হোস্টিং এর শাসনকালের সূচনা প্রজন্ত বিহারের ইতিহাস তুলে ধরেন।

(২) বাংলা ভাষায় ইতিহাস বাংলা ভাষায় ইতিহাস : বাংলা ভাষায় শুধু বাংলার নয় ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উপর ইতিহাস লেখা হয়। পশ্চিমী ভাব ধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়েই বাঙালিরা ইতিহাস লিখন প্রবৃত্ত হন। উনিশ শতকে এক্কেবারে ঘোড়ার দিকে রাম রাম বসু লেখেন ‘প্রতাপাদিত্য চরিত্র’ এবং রাজিব লোচন মুখোপাধ্যায় লেখেন ‘মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রহস্য চরিত্রম’, আর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর লেখেন ‘বাংলার ইতিহাস দ্বিতীয় ভাগ’।

রাখাল দাস বন্দোপাধ্যায় দুই খন্ডে বাংলার ইতিহাস লেখেন আঞ্চলিক ইতিহাস হিসেবে রাজনারায়ণ ভট্টাচার্জ লেখেন ‘পাঞ্জাবেতিহাস’, রাজেন্দ্রলাল মিত্র লেখেন ‘মেবারের রাজেতিবৃত’, সতীন্দ্রনারায়ণ রায় ‘ওড়িশার কথা’ , আর যোগেন্দ্র নাথ গুপ্ত ‘আসামের ইতিহাস’ রচনা করেন। এছাড়াও সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বিপ্লবী রাশিয়া’ এবং বিনয় কুমার সরকার ‘বর্তমান যুগকে চীন সাম্রাজ্য’ নামে গ্রন্থ লেখেন। প্রবোধ চন্দ্র বাগচি তিনখানি গ্রন্থ লেখেন যথা – ‘ভারত ও মধ্য এশিয়া’, ‘ভারত ও ইন্দ্রোচীন’ এবং ‘ভারত ও চীন’।

৪. অর্থনৈতিক ইতিহাস

ব্রিটিশের নিদারুণ আর্থিক শোষণ এবং সাম্রাজ্যবাদী অর্থনৈতিক প্রতিবাদ হিসেবে অর্থনীতির ওপর কয়েকটি গ্রন্থ রচিত হয়। ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক অবস্থার প্রতি ব্রিটিশের উদাসীনতাকে দায়ী করে দাদাভাই নৌরাজী ‘প্রভার্টি এন্ড আন-ব্রিটিশ রুল ইন ইন্ডিয়া’ গ্রন্থটি রচনা করেন। এই গ্রন্থে তিনি ভারতের নিদারুণ দারিদ্রের জন্য ব্রিটিশ শাসকের দাবি করেন। এদের তিনি দেখাতে চেষ্টা করেন কিভাবে ব্রিটিশের আর্থিক শাসন ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্পকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। নৌরাজ তার ‘নির্গমন তত্ত্ব’ পেশ করে ভারতের দারিদ্র্যের জন্য ব্রিটিশ কর্তৃক ভারতের সম্পদ নিষ্কাশন কে দায়ী করেন।

এই গ্রন্থটিতে উনিশ শতকের ভারতীয় অর্থনীতির বহু তথ্যস্থান পায়। রমেশ চন্দ্র দত্ত তার দু খন্ডে রচিত ‘ইকোনমিক হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে ব্রিটিশ অর্থনীতির শোষণ মূলক দিকটি তুলে ধরেন। তিনি দাবি জানিয়ে বলেন ভারতের দারিদ্র্যের মূল কারণ অনুসন্ধান করতে হবে তার ভূমি সমস্যার মধ্যে। এই আর্থিক ইতিহাস ভাবনাকে অনুসরণ করে পরবর্তীকালে ঔপনিবেশিক অর্থনীতির সমালোচনা করে মহাদেব গোবিন্দ রানাডে, অমলেশ ত্রিপাঠী, নরেন্দ্র কৃষ্ণ সিংহ, গোপালকৃষ্ণ গোখলে, জি. ভি. জোশি ও কে. টি. তেলাং প্রমুখ।

৫. জাতীয়তাবাদী ইতিহাস

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকের ভারতীয়দের জাতিগতভাবে নিকৃষ্ট বলে মনে করতেন। শাসক ব্রিটিশ এর কাছে শাসিত ভারতীয়রা ছিল ঘৃন্য ও করুণার পাত্র। ভারতীয়দের প্রতি ব্রিটিশের রেহানো আচরণ ও মনোভাবের প্রতিবাদ হিসেবে জাতীয়তাবাদী ইতিহাস রচনা শুরু হয়। ব্রিটিশের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যেও জাতীয়তাবাদী ইতিহাস রচনা করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ভারতের অতীত গৌরবকে পুনরায় তুলে ধরে এই ধরনের ইতিহাস লেখা শুরু হয়। ভারতীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতা উৎকর্ষণ তুলে ধরে রমেশ চন্দ্র যত তিনি খন্ডে লেখেন ‘সিভিলাইজেশন এনসিয়েন্ট ইন্ডিয়া’ গ্রন্থটি।

জাতির গর্ভে গর্বিত কে. পি. জয়স‌ওয়াল হিন্দু পলিটি লিখে দেখানোর চেষ্টা করেন যে প্রাচীন ভারতের শুধু যে সংবিধানিক সরকার চালু ছিল তাই নয় ভোটের মাধ্যমে অনুদান মঞ্জুর এবং রাজসিংহাসন থেকে জনগণকে সম্মোধন সমগ্র সংসদীয় ব্যবস্থা চালু ছিল। রাধাকুমুদ মুখার্জি তার ‘ The Fundamental Unity of India ‘ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন-সর্বভারতীয় সাম্রাজ্যের আদর্শ, ধর্মীয় ঐক্য ও আধ্যাত্মিকতাবাদের ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তি রচনা করে। এছাড়াও জাতীয় ইতিহাস গ্রন্থ গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য শশীভূষণ চৌধুরী রচিত ‘সিভিল ডিস্টারবেন্স ডিউরিং ব্রিটিশ রুল ইন ইন্ডিয়া’, বা. রমেশ চন্দ্র মজুমদার রচিত ‘হিস্ট্রি অ্যান্ড কালচার অফ দা ইন্ডিয়ান পিপল’ প্রভৃতি।

৬. সামাজিক ইতিহাস

ঔপনিবেশিক শাসনের সামাজিক দিক থেকে ভারতীয়রা কোনরকম সুযোগ-সুবিধা পেতো না। ব্রিটিশদের ধারণায় বিভিন্ন কুসংস্কার ও দুর্বল সামাজিক রীতিনীতি দারুন ভারতীয়রা ছিল অধঃপতিত জাতি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমাজকে সভ্যতার নিরিখে বিচার করে বলেন ইউরোপের ইতিহাস রাষ্ট্রকেন্দ্রিক হলেও ভারতের ইতিহাস সমাজ কেন্দ্রিক। তিনি বলেন আমাদের দেশের সমাজ যদি পুঙ্গ হয় তাহলে আমাদের দেশের সামনেও সংকট উপস্থিত হবে। ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় সমাজ ভাবনার উদ্বুদ্ধ হয়ে রানাডে ‘রেলিজিয়াস এন্ড সোশ্যাল রিফর্মস’, শিবনাথ শাস্ত্রী ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গ সমাজ’, প্রদীপ সিংহ ‘নাইনটিনথ সেঞ্চুরি বেঙ্গল : অ্যাসপেক্টস অব সোশ্যাল হিস্ট্রি’, সালাউদ্দিন আহম্মদ ‘সোশ্যাল আইডিয়া এন্ড সোশ্যাল চেঞ্জ ইন বেঙ্গল’, নগেন্দ্রনাথ বসু ‘বাংলার জাতীয় ইতিহাস’ , দুর্গাদাস সান্যাল ‘বাংলা সামাজিক ইতিহাস’, শিবেন্দ্রনারায়ণ শাস্ত্রী ‘বাংলার পরিবারিক ইতিহাস’, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ‘সমাজ পদ্ধতির’ প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন।

৭. সংস্কৃতি ইতিহাস

সুপ্রাচীন সনাতন ভারতীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্য কে ব্রিটিশ কালিমা লিপ্ত ও নস্যাৎ করে দিতে চাইলে ভারতীয়রা পূর্ণ উদ্যমে অতীত সংস্কৃতি পূর্ণ লিখন শুরু করেন। আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন ‘ভারতীয় মধ্যযুগের সাধনার ধারা ও ভারতের সংস্কৃতি’ লিখে সমন্বয়বাদি ভারতীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্যপূর্ণ প্রতিষ্ঠা ঘটান। প্রথম নাত মুখার্জি ইতিহাস ও অভিব্যক্তি গ্রন্থটি রচনার মাধ্যমে সনাতন ভারতে ধর্ম, দর্শন ও সংস্কৃতিকে নতুনভাবে তুলে ধরেন ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে ভারতীয় সংস্কৃতি তুলনামূলক আলোচনা করেন। সুকুমার সেন বাংলা ও বাঙালি গ্রন্থের প্রাচীন বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির পরিচয় তুলে ধরেন। সতীশ চন্দ্র মিত্রের ‘যশোর-খুলনার ইতিহাস’, নিখিল নাথ রায়ের ‘মুর্শিদাবাদের ইতিহাস’ আনন্দ নাথ রায়ের ‘ফরিদপুরের ইতিহাস’ , বিজয় চন্দ্র মজুমদারের ‘ঢাকার ইতিহাস’, অচ্যতচরণ চৌধুরীর ‘শ্রী হটের ইতিহাস’, কৈলাসচন্দ্র সিংহের ‘ত্রিপুরার ইতিবৃত্ত’ রবিতে ঘন্টা আঞ্চলিক সমাজ চিত্র ধরা পড়ে।

উপসংহার

অতীতে উত্তরাধিকার ধারায় দেশীয় ইতিহাস চর্চা কল্পনা শক্তিকে প্রভাবিত করেছিল পশ্চিমী ভাবধারা। প্রাচ্য তত্ত্ববিদগণ এদেশের সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানলে, শাসিত ভারতীয় জাতিকে বিশ্বের দরবারে অপদস্থ করতে চাইলে শিক্ষিত বুদ্ধিজীবগণ দেশীয় ইতিহাস রচনায় প্রবৃত্ত হন। নৈতিকতা, প্রগতিবাদ, স্বদেশিকতা, দেশীয় ঐতিহ্য তাদের চিন্তা ভাবনাকে আলোড়িত করেছিল। ইতিহাস রচনার দ্বারা দেশীয় ঐতিহাসিকগণ এদিকে যেমন ভারতীয় শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন অপরদিকে তেমন ব্রিটিশ ইতিহাস রচনার দ্বারা দেশীয় ঐতিহাসিকগণ এদিকে যেমন ভারতীয় শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন অপরদিকে তেমন ব্রিটিশ অপসনের বিরুদ্ধে স্বদেশীবাসীকে সচেতন করে তুলতে চেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাই বলেছেন-“ভারত ইতিহাসের মূল সুর হলো ঐক্য ও সমন্বয়ের।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment